lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
মঙ্গলবার, ২৭ জুন, ২০২৩
Last Updated 2023-06-27T03:17:47Z
জাতীয়

প্রতিবন্ধকতায় হার মানেনি প্রতিবন্ধী লুৎফর

Advertisement

এম এ সালাম মুর্শেদী, (পঞ্চগড়) প্রতিনিধিঃ 

জন্মের তিন মাস পরে তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত অনেক গুলো ঘাঁ হয়। প্রথমে এলাকার হাতুড়ি ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাই। কিন্তু ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। তারপরেও গরীবি হালে যতদূর সম্ভব চিকিৎসা করিয়েছিলাম। কিন্তু অর্থের অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারিনি। বয়স যত বাড়ে সে ততই দুর্বল হয়ে পড়ে। বসয় বাড়ার সাথে সাথে হাঁটার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সে। তার পা দুটি সোজা করতে পারেনা। হাত আট হাঁটুর উপরে ভর করে হাঁটাচলা করে। আজ সেই ছেলের উপার্জনের টাকায় আমার সংসার চলে। এযেন আমার বেঁচে থেকেই পরপারের কষ্ট ভোগ করার সমতুল্য। 

এভাবেই আবেগে আপ্লূত হয়ে প্রতিবন্ধী ছেলের হার না মানা জীবনের একেক অধ্যায়ের করুণ ইতিহাসের বর্ণনা দিচ্ছিলেন মা মায়না। 

বলছিলাম পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার ছোটদাপ গ্রামের মোঃ লুৎফর রহমানের (৩০) এর কথা। সে ওই গ্রামের মোঃ তরিকুল ইসলামের ছেলে।  পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে বড় বোনের পরেই লুৎফর এবং বাকি তিন ভাই ছোট। অভাব-অনাটনের মধ্যেই বর্তমানে মা-বাবা ও ছোট ভাইদের নিয়ে তার বড় একটা সংসার। আর এই সংসারের বাড়তি বোঝা হয়ে না থেকে সংসারের বাড়তি অর্থ উপার্জন করতে  অন্যের সাইকেল মেকানিকের দোকানে কাজ করে লুৎফর। 

লুৎফরের বাবা একজন দিনমজুর। ভাইগুলোও ছোট। কেউ বাবা'র সাথে মাঝে মাঝে অন্যের বাড়িতে কাজ করে। আবার মাঝে মাঝে স্কুলেও যায় তারা।  আর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই সংসারের হাল ধরতে নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে কাজ করে উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন সাইকেল মেকানিক মামুনের দোকানে। সেখানে প্রায় সাত বছর ধরে সাইকেল মেকানিকের কাজ করছে লুৎফর। 

দিনে শেষে কাজের উপর নির্ভর করে দুই থেকে আড়াই'শ টাকা মজুরি পায় সে। তাই দিয়ে বাড়ির প্রয়োজনীয় সদাই-পাতিসহ ঔষধপত্র কেনে হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, লুৎফর সাইকেল মেকানিকের কাজ করছে উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন মামুনের দোকানে। সেখানে  সাইকেল ও ভ্যানের বিভিন্ন অংশের মেরামত কার করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে সে।  

কাজ করাবস্থায় যদি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয় তবে তাকে যেতে হবে মাত্র চল্লিশ ফুট দূরত্বে। যেখানে যেতে একজন সাধারণ স্বাভাবিক মানুষের সময় লাগবে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। আর তার সময় লাগে প্রায় আট থেকে দশ মিনিট। কারণ সে হাত ও  হাঁটুর উপরে ভর করে চলে। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে একটি হুইলচেয়ার পেয়েছে লুৎফর। সেটা হাতের সাহায্যে প্যাডেল চালিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে। প্রতিবন্ধী ভাতাও পায়। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়। 

এনিয়ে লুৎফরের সাথে কথা বললে সে জানায়, "আমি ছোট থেকেই হাঁটাচলা করতে পারিনা। পা দুটি সোজা করা যায়না। পরিবারে মা-বাবা, তিন ছোট ভাইসহ ছয় জনের বড় সংসার। আমিই ভাইদের মধ্যে বড়। বাবার অনেক বয়স হয়েছে। কাজও ঠিকঠাক করতে পারেনা। ভাইগুলোও ছোট। তাই বড় ছেলে হিসেবে মা-বাবা'র সুখ ও ছোট ভাইদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে আমি এ কাজ করি। আমি চলাচল করতে ও দাঁড়াতে পারিনা। তাই মেকানিকের কাজ করি। কারণ এই কাজ মাটিতে বসেও করা যায়। সারাদিন যা উপার্জন করি তা  সংসারের কাজে ব্যয় করি। আমি এর আগে অন্য জায়গায় চার বছর মেকানিকের কাজ শিখেছি ও করেছি। এখানে প্রায় সাত বছর থেকে কাজ করি। আমি উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে পরিষদের সামনেই কাজ করছি। এপাশ দিয়ে কতশত অফিসার ও ধর্ণাঢ্য ব্যাক্তিরা যাতায়াত করে কিন্তু কারো চোখে আমি পরিনা। গরীব প্রতিবন্ধী বলে অনেকেই অবহেলা করে। তারপরও আমি দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। এই পা গুলো দিয়ে আমি হাঁটতে বা চলাচল করতে পারিনা তারপরও নিজের পরিশ্রম ও কাজের মাধ্যমে আমি নিজের পায়ে দাড়াতে চাই"।

দোকানের মালিক মামুন জানায়, "লুৎফর গত কয়েক বছর থেকে অনেক ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে। তার কাজের সার্ভিসও অনেক ভালো। সাইকেল ও ভ্যানের যেকোনো সমস্যা সঠিকভাবে নিরুপন করতে পারে। তার জন্য পূর্বের চেয়ে আমার কাস্টমার বেড়ে গেছে। সে আমার বিশ্বস্ত একজন মানুষ। আমি তাকে যতটুকু পারি সাহায্য করি। তার কাছে প্রতিবন্ধকতা নয় কাজের গুরুত্ব অনেক বেশি"।