Advertisement
এম এ সালাম মুর্শেদী, (পঞ্চগড়) প্রতিনিধিঃ
পঞ্চগড়ের আটোয়ারী রেজিস্ট্রি অফিসের সাব রেজিস্ট্রার মো: মিজানুর রহমান দিনে আয় করেন প্রায় দুই লাখ টাকা। টাকা ছাড়া কোনো কাজ না করার লাগামহীন অভিযোগ ও পুকুর চুরি করাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তিনার বিরুদ্ধে। যেন সাব রেজিস্ট্রি অফিস ভবনের ইট বালিও টাকা ছাড়া কথা শোনে না।
দুর্নীতিতে জর্জরিত সাব রেজিস্ট্রার মিজানুরসহ অফিস স্টাফের অনেকেই। টাকা দিলে জমি রেজিস্ট্রি করার সময়ও বিভিন্ন অনিয়ম নিয়মে পরিনত হয়ে যায় তিনার কাছে। এই ধরুন, দলিলের কিছু অক্ষর স্পষ্ট বোঝা না গেলে তার ঘষামাজার মাধ্যমে সংশোধন করা সম্ভব, তবে বিনিময়ে গুনতে হবে ৫/৬ হাজার টাকা।
এছাড়াও জমি রেজিস্ট্রির পূর্বে ব্যাংক মরগেসের জন্যেও গুনতে হয় ৪/৫ হাজার টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, আব্দুর রাজ্জাক নামে এক ব্যাক্তির কাছে ৪ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে ব্যাংক মরগেসের জন্য। আর আটোয়ারী আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নানের কাছেও ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। পরে তা ইউএনও'র মাধ্যমে সমাধান হয়েছিল।
এদিকে, তৌহিদুল ইসলাম নামে এক ইউপি সদস্য জানান, আমি জমি রেজিস্ট্রি করতে গেলাম। আমার কাগজপত্র সবকিছু ঠিক থাকার পরও রেজিস্ট্রি করে দিলেন না। বলেন দলিলে কয়েকটি সমস্যা রয়েছে। তাই রেজিস্ট্রি হবেনা। কিন্তু কিচ্ছুক্ষণ পর তিনার এক দলিল লেখকের মাধ্যমে ১২ হাজার টাকা চেয়েছেন। যদি না দেই তবে রেজিস্ট্রিও না হওয়ার কথা জানান সাব রেজিস্ট্রার। তাই জমি রেজিস্ট্রি না করেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
এছাড়াও হেবা অর্থ্যাৎ জমি দানের বিষয়ে রেজিস্ট্রি করতে গেলে অগ্রীম দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দলিল লেখক জানান, এমন ঘুষের টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দন্দ্বদের জেড়ে দলিল লেখক সভাপতি গোলাম উদ্দিনকে সাব রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান তার খাস কামরায় আটকে রেখেছিলেন। পরে কয়েকজন দলিল লেখক টাকা পরিশোধ করে তাকে মুক্ত করেন।
জমি রেজিস্ট্রি করার ক্ষেত্রে ওয়ারিশান সার্টিফিকেটেরও প্রয়োজন হয়ে থাকে। কিন্তু অজ্ঞাত পরিচয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলিল লেখক সভাপতি গোলাম উদ্দিন বলেন, টাকা দিলে সব হবে। আমরাই ওয়ারিশান পত্র বানিয়ে দিতে পারি সই সীল সহ। তবে, খরচ পরবে প্রায় ৬/৭ হাজার টাকা। স্যার (সাব রেজিস্ট্রার) কেই দিতে হবে সব। টাকা দিলে এক দিনেই কাজ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
এছাড়াও পরিচয় গোপন রেখে জমি রেজিস্ট্রির বিভিন্ন জটিলতার সমাধান চাইলে এর উপায় ও কলাকৌশল বলে দেন দলিল লেখক মো: জহিরুল ইসলাম। তিনি জানান, দলিল ঘষামাজার জন্য স্যারকে দিতে হবে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। আর আমাদের চা খরচসহ মোট ৫ হাজারের মতো পরবে। প্রতিবেদক তার কাছে জানতে চান, জমি রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত দুইটা সমস্যা রয়েছে। এর জবাবে তিনি আরো বলেন সব সমস্যা একসাথে নিয়ে আসতে। তাহলে নাকি সাব রেজিস্ট্রার মিজানুর কম্বো অফারে সব সমস্যা সমাধান করে দিবেন। অর্থ্যাৎ একটা সমস্যা নিয়ে গেলে কম খরচে হয়না এবং একাধিক সমস্যা থাকলে তা কিছুটা কম খরচেই সমাধান হয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দলিল লেখক বলেন, স্যারের প্রতিদিনের ইনকামের ছিটেফোঁটা কয়েকজন দলিল লেখকের পকেটে যায়। তাই তাঁরা উনার বিপক্ষে মুখ খুলেন না। স্যার সরাসরি টাকা না নিয়ে কয়েকজন দলিল লেখকের মাধ্যমে সব কালোবাজারির কারসাজি ও আর্থিক লেনদেন করেন। তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন এখানে জমি রেজিস্ট্রি হয় প্রায় ৩৫/৪০ টি। প্রতিটি দলিলে টাকা খাওয়ার জন্য কোন না কোন ভুলত্রুটি বের করেন। পরে ৫/১০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রতিটি দলিল পাস করা হয়। এতে এক দিনেই সাহেব আয় প্রায় ২ লাখ টাকার উপরে। এছাড়া আরো বিভিন্ন অনিয়ম তো রয়েছেই। আর এই অবৈধ ইনকামের ভাগবাটোয়ারা হয় কয়েকজন দলিল লেখকের সাথে। তাই সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে তাঁরা অবস্থান করেন না।
এদিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাব রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান এজলাসে না বসে তিনার খাস কামরায় বসে জমি রেজিস্ট্রি করেন। এসময় তার খাস কামরায় যেন কেউ যেতে না পারে সে জন্য দরজার সামনে অতিরিক্ত দ্বায়িত্বে রেখেছেন অফিস সহায়ক বাবু'কে। তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিবেদক দরজার কাছে গেলে তার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। খাস কামরার ভিতরের অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের চিত্র বাইরে থেকে দেখা না যাওয়ার জন্য চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সাব রেজিস্ট্রারের কক্ষের কাঁচের সাদা জানালাগুলো কালো রং করে দিয়েছেন।
এছাড়াও সাব রেজিস্ট্রারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে এটিএন বাংলা টেলিভিশনের সংবাদকর্মীসহ কয়েকজনকে আটকে রেখে হেনস্তা ও মারধরও করা হয়৷ এবিষয়ে একটি মামলা বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এমন অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে সাব রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, "আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ বা অনিয়ম থাকলে আপনারা আমার উর্ধ্বতন কর্মকতার কাছে খবর দেন"। এ ছাড়া তিনি আর কোন কথার উত্তর দেননি।
এমন দুর্নীতিগ্রস্থ সাব রেজিস্ট্রারকে অনতিবিলম্ব চাকরিচ্যুত করে উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সুশীল সমাজ ও ভুক্তভোগীরা। তারা বলেন, "এভাবে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে দিনে দুপুরে শিক্ষিতে বেশ ধরে ডাকাতি করছে সাব রেজিস্ট্রার। কারণ আটোয়ারী একটি প্রত্ত্যন্ত ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী গরীবদের উপজেলা। এখানে এমন দুর্নীতি চলতে থাকলে উপজেলার জমি রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত সকল মানুষ নি:স্ব হয়ে যাবে"।