Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
‘আমার পুলারে (ছেলে) কেউ আইন্না (এনে) দেও। চাইর (চার) মাস আগে পুলার (ছেলের) বাপ মইরা গেলগা। আইজ পুলা নাই। আমরার সব শেষ অই (হয়ে) গেল। আমার পুলার বউ আর দুইটা ছোট নাতি-নাতিনরে আমি কিতা কইয়া (বলে) শান্তনা দিমু (দেবো)? কেটা আমার নাতি-নাতিন দুইটারে দেইখা রাখব?’ বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নের গাজীপুর গ্রামের বাসিন্দা নির্মমভাবে খুনের শিকার মিনি টমটম চালক আবুল খায়েরের মা মোছা. খোদেজা বেগম। খুনের শিকার নিহতের সদ্য বিধবা স্ত্রী সুমনা বেগম (২৪) তার দশ মাস বয়সী ছেলে ছায়েদ হোসেন ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে সাবিহা জান্নাতকে বুকে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করছেন। তাদের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। আবুল খায়েরের অকাল মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সোমবার (১৪ অক্টোবর) দিবাগত রাতের কোন এক সময় গাজীপুর গ্রামের মৃত আনছর আলীর ছেলে মিনি টমটম চালক আবুল খায়েরকে নির্মমভাবে খুন করে তার নতুন টমটমটি ছিনতাই করে নিয়ে গেছে অজ্ঞাত দুস্কৃতিকারীরা। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সকালে তার বাড়ি থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দুরে অবস্থিত ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়নের কালিঘাট চা বাগানের ১১ নম্বর সেকশন থেকে পুলিশ আবুল খায়েরের মরদেহ উদ্ধার করে। তার গলায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
নিহতের পরিবার সূত্র জানায়, তাদের পারিবারিক নিবাস ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নের গাজীপুর গ্রামে হলেও নিহত আবুল খায়ের স্ত্রী-সন্তানসহ একই ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে প্রবাসী আব্দুল হান্নানের বাসায় কেয়ারটেকার হিসেবে বসবাস করতেন। গত প্রায় চার মাস আগে আকস্মিকভাবে আবুল খায়েরের বাবা মো. আনছর আলী মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে আবুল খায়েরের পরিবার যেন অকূল সাগরে নিপতিত হয়। ছোট দুটি শিশু সন্তান, স্ত্রী ও মা-ভাই-বোনকে নিয়ে খায়েরের পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় প্রবাসী আব্দুল হান্নান গত এক মাস পূর্বে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে একটি মিনি টমটম কিনে দেন আবুল খায়েরকে। প্রতিদিন সকালে আবুল খায়ের প্রবাসী হান্নানের সন্তানদের ওই টমটমে করে মাদরাসায় নিয়ে যেতেন আর বিকেলে নিয়ে আসতেন। বাকি সময় তিনি ভাড়ায় টমটম চালিয়ে পরিবারের খরচ নির্বাহ করতেন। পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে পরিবারটি।
নিহতের বড়বোন ইয়াসমিন বেগম বলেন, ‘সোমবার রাত এগারোটার দিকে মুসলিমবাগ গাংপাড় এলাকা থেকে আবুল খায়ের তার নতুন মিনি টমটম নিয়ে রামনগর গ্রামের দিকে রওয়ানা হয়। এরপর থেকে সে নিখোঁজ রয়েছে। রাত তিনটার দিকে প্রবাসী আব্দুল হান্নান মোবাইল ফোনে কল করে জানান, খায়ের বাড়ি যায়নি। তার মোবাইলও বন্ধ। এরপর আমরাও তার মোবাইলে ফোন করে বন্ধ পাই। সাথে সাথেই আমি, আমার মাসহ আত্মীয়-স্বজন শহরের বিভিন্ন স্থানে তাকে খোঁজ করি। পরে খবর পাই আমার ভাইয়ের লাশ চা বাগানে পড়ে রয়েছে। এ খবর শুনে আমরা ছুটে যাই ঘটনাস্থলে। পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করেছে। আমার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে ঘাতকরা হত্যা করেছে। আমরা আমার ভাইয়ের খুনের সাথে জড়িত সবার উপযুক্ত বিচার চাই।
নিহতের স্ত্রী সুমনা আক্তার বলেন, ‘আমি অল্প বয়সে দুটি ছোট শিশু সন্তানকে নিয়ে বিপদে পড়েছি। আমি আমার স্বামীর হত্যার সাথে জড়িত সবার বিচার চাই।’
শ্রীমঙ্গল থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি এটি একটি হত্যাকান্ড। নিহতের গলা, পেটসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়না তদন্তের জন্য আমরা মরদেহ মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছি। আমরা গুরুত্ব সহকারে ঘটনাটির তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে এ ঘটনার বিস্তারিত জানানো হবে।’