lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪
Last Updated 2024-10-08T09:30:12Z
অনিয়ম - দুর্নীতি

সাবেক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ

Advertisement


 


ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:

সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ও তার ছেলে জাকির হোসেন জুমনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের প্রাথমিক অনুসন্ধানের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা ইউনিট। অনুসন্ধানে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আরও দু’জনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে। তারা হলেন সাবেক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারী কবিরুজ্জামান চৌধুরী ও তার সাবেক মন্ত্রী ভাগনে বড়লেখা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শোয়েব আহমদ। গোয়েন্দা ইউনিটের প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিক সংবাদের ভিত্তিতে শাহাব উদ্দিনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগগুলো অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট। অভিযোগের প্রাথমিক অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়ায় সংস্থাটির দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেলের পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল অভিযোগটির পরবর্তী কার্যক্রম (প্রকাশ্যে তদন্ত) গ্রহণের জন্য গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিবেদনসহ মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) বরাবর চিঠি দিয়েছেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।’

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা) আসন থেকে চতুর্থবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর মো. শাহাব উদ্দিন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। মন্ত্রী হবার পর তিনি ও তার যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছেলে জাকির হোসেন জুমন বিশ্ব ব্যাংকের পাঁচ বছর মেয়াদি ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকার ‘সুফল প্রকল্প’ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়ে ঠিকাদারদের কাজ প্রদান এবং বিভিন্ন খাতে ভুয়া খরচ দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। বন কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ এবং পরিবেশ দূষণে মারাত্মক প্রভাব রয়েছে এরূপ তরল বর্জ্য সৃষ্টিকারী কলকারখানায় ইটিপি পরিদর্শন ছাড়াই সনদ প্রদানের অভিযোগ রয়েছে সাবেক এ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। এছাড়াও ৭ কোটি টাকার বিনিময়ে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জমির রেজুলেশনে স্বাক্ষর করে বিএফডিআইসি’র চেয়ারম্যানকে ওই জমি জলবায়ু ট্রাস্টকে দেওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়েছে এমন অভিযোগও ওঠেছে সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে।


ইউপি চেয়ারম্যান থেকে মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন

মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার পাখিয়ালা গ্রামের মো. আব্দুর রহিম ও আনোয়ারা বেগমের সন্তান শাহাব উদ্দিন। সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর বড়লেখার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন তিনি। ১৯৮৪ সালে ৬ নম্বর বড়লেখা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো, ১৯৮৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এবং ১৯৯২ সালে তৃতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। 

১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মো. শাহাব উদ্দিন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার-১ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করে নির্বাচিত হন এবং ওই সংসদে তিনি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্ব›দ্বীতা করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট এবাদুর রহমান চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পুনরায় বিজয়ী হয়ে নবম জাতীয় সংসদে ভূমি মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেভিওয়েট কোন প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকায় সহজেই বিজয়ী হয়ে শাহাব উদ্দিন প্রতিন্ত্রী মর্যাদায় জাতীয় সংসদের হুইপ এবং একইসাথে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিকার কমিটি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন্স অব পার্লামেন্টারিয়ান অন পপুলেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিএপিপিডি) এবং নিরাপদ মাতৃত্ব ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন বিষয়ক সাব-কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মৌলভীবাজার-১ আসন থেকে চতুর্থবারেরমতো বিজয়ী হবার পর শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় তিনি পরিবেশ, বন ও জলবায়ুু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একতরফা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য পদে বিজয়ী হন। ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে মো. শাহাব উদ্দিন এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে ক্লিন ইমেজ, বিজ্ঞ রাজনীতিক ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংসদ সদস্য হবার পর থেকে শাহাব উদ্দিনের ক্লিন ইমেজে ফাটল ধরতে থাকে। ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাবার পর থেকে শাহাব উদ্দিন হয়ে ওঠেন দুর্নীতি-অনিয়মের বরপুত্র। 

 

মন্ত্রী হবার পরই ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা!২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসন থেকে নির্বাচিত হবার পর মো. শাহাব উদ্দিন পরিবেশ, বন ও জলবায়ুু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ওই সময় তার ছেলে জাকির হোসেন জুমন যুক্তরাজ্য থেকে দেশে চলে আসেন। দেশে এসে তিনি একটি কালো রঙের প্রাইভেট কারে করে গানম্যানসহ বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলা দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন। এই প্রাইভেট কারের সামনে সাইরেন বাঁজিয়ে চলাচল করতো পুলিশের প্রটোকল গাড়ি। জাকির হোসেন জুমন ভিআইপি কেউ না হলেও বাবার ক্ষমতায় তিনি নিজে ছিলেন প্রচুর ক্ষমতাবান। শাহাব উদ্দিন মন্ত্রী থাকাবস্থায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত বন ও জলবায়ুু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীপুত্র জাকির হোসেন জুমনের ছিল প্রচ্ছন্ন প্রভাব। মন্ত্রণালয় পরিচালনায় নেপথ্যে ভূমিকাও পালন করতেন তিনি। উৎকোচের বিনিময়ে বিশ্ব ব্যাংকের পাঁচ বছর মেয়াদি ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকার ‘সুফল প্রকল্পে’ ঠিকাদারী কাজের বরাদ্দ দিতেন জুমন। শুধু জুমনই নয় সাবেক মন্ত্রীর ভাগনে বড়লেখা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শোয়েব আহমদ, তার ছোট ভাই ৬ নম্বর বড়লেখা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছালেহ আহমদ জুয়েল, মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী কবিরুজ্জামান চৌধুরীসহ সাবেক বন মন্ত্রীর স্বজনরা দুই উপজেলায় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। শাহাব উদ্দিন মন্ত্রী থাকাবস্থায় তার ছেলে ও স্বজনদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে পাহাড়ি ভূমি অবাধে দখল করে বাংলো নির্মাণ, বনের গাছ সাবাড়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন প্রদান, মন্ত্রণালয়ে বদলি বাণিজ্যের। এসব দুর্নীতি-অনিয়মের অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।