lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪
Last Updated 2024-10-03T08:22:25Z
আইন অপরাধ

মৌলভীবাজারে শিক্ষিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল কারাগারে

Advertisement


 

ঘটনার আড়াই বছর পর মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার

আওয়ামী ঘরাণার নেতাদের সহযোগিতায় এতোদিন ছিলেন বহাল তবিয়তে

 ধর্ষণ ঘটনা প্রমাণের পর মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতির পর পুনরায় জোরপূর্বক প্রিন্সিপালের পদ দখল

২০২৩ সালের শেষদিকে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের হলেও আইনী সহায়তা পাননি ভুক্তভোগী


ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:

নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ ঘটনার পর প্রায় আড়াই বছর মৌলভীবাজারের জামেয়া আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মহিলা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আলতাফুর রহমান সাদিকী (৩২) ছিলেন ধরা ছোয়ার বাইরে। ধর্ষণ ঘটনা প্রমাণ হবার পর মৌলভীবাজার জেলা ওলামা পরিষদ থেকে তাকে বহিষ্কার ও কওমি অঙ্গন থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। তার নিজের স্বীকারোক্তি মতে তাকে মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পদ থেকে অব্যাহতির পর আওয়ামী ঘরাণার প্রভাবশালী নেতাদের সহযোগিতায় পুনরায় প্রিন্সিপালের পদ দখল করে নেন তিনি। এতোদিন আওয়ামী ঘরাণার কিছু নেতা ও সরকারি দলের (আওয়ামী) সমর্থক কথিত আলেমদের সহযোগিতায় মাদ্রাসার কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও অবশেষে আর নিজেকে শেষ রক্ষা করতে পারেননি তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠানের ওই শিক্ষিকাকে ধর্ষণ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আড়াই বছর পর তাকে যেতে হয়েছে কারাগারে। গত মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) মৌলভীবাজার সদর মডেল থানায় মাওলানা আলতাফুর রহমানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী শিক্ষিকা। তার দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে বুধবার (২ অক্টোবর) অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তারের পর জেলার শীর্ষ আলেম সমাজে বিরাজ করছে উৎফুল্লতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে নানা ধরণের মন্তব্য করছেন নেটিজেনরা।

তথ্যানুন্ধান ও ভুক্তভোগীর অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১১ নম্বর মোস্তফাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম মোস্তফাপুর (খিদুর) গ্রামে অবস্থিত জামেয়া আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয় ২০১৮ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ২ নম্বর পতনঊষার ইউনিয়নের সোনারগাঁও (পূর্ব বলরামপুর) গ্রামের মৃত আশিক মিয়ার ছেলে মাওলানা আলতাফুর রহমান সাদিকী (৩২)। আর ধর্ষণের শিকার শিক্ষিকা ২০১৯ সাল থেকে ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা শুরু করেন। ওই শিক্ষিকাকে মাদ্রাসায় থাকাবস্থায় প্রিন্সিপাল আলতাফুর রহমান সাদিকী নানাভাবে বলপ্রয়োগ, প্রভাব বিস্তার ও প্রলোভন দেখিয়ে ২০২২ সালের ২০ মার্চ মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ধর্ষণ করেন। ওইদিন মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা হলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও অন্যান্য শিক্ষকরা নিজ নিজ বাড়িতে চলে যান। কিন্তু প্রিন্সিপাল আলতাফুর রহমান সাদিকী রাত হয়ে যাওয়ার অজুহাতে ওই শিক্ষিকাকে পরদিন বাড়িতে যেতে বলেন। রাতে মাদ্রাসায় একা রেখে ওই শিক্ষিকাকে ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ করেন। ঘটনার পর ধর্ষণের শিকার ওই শিক্ষিকা মাদ্রাসার চাকরী ছেড়ে চলে যান। এরইমধ্যে ২০২২ সালের মে মাসে মৌলভীবাজার শহরের এক ব্যবসায়ী ও আলেমের সাথে ওই শিক্ষিকার সামাজিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পর ধর্ষণের ভিডিও শিক্ষিকার স্বামীকে দেখানোর ভয় দেখিয়ে প্রিন্সিপাল আলতাফুর রহমান সাদিকী প্রায় সময়ই ওই ভুক্তভোগী নারীর সাথে মোবাইলে কথা বলতেন এবং তাকে মাদ্রাসায় যাবার প্রস্তাব দিতেন। এক পর্যায়ে শিক্ষিকার স্বামী বিষয়টি জানতে পেরে মৌলভীবাজার উলামা পরিষদের নেতৃবৃন্দ এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়ে উক্ত মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও মৌলভীবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আলহাজ্ব আয়াছ আহমদ, মাওলানা মনসুরুল হাছান রায়পুরী, মুফতি শামছুদ্দোহা, মুফতি হাবিবুর রহমানসহ অন্যান্যরা মাওলানা আলতাফুর রহমান সাদিকীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সকলের সামনেই তার অপরাধ স্বীকার করেন। এরপর আলতাফকে তৎকালীন সময় মাদরাসার প্রিন্সিপালের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এদিকে উলামা পরিষদ তদন্তপূর্বক ধর্ষণের সঙ্গে মাওলানা আলতাফুর রহমানের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর তাকে ওলামা পরিষদ থেকে বহিষ্কার ও কওমি অঙ্গনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। অব্যাহতির কয়েক মাস পরে আলতাফুর রহমান সাদিকী স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী ঘরাণার নেতাদের সহযোগিতায় পুনরায় মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের পদ দখল করে নেন। এদিকে ২০২৩ সালের শেষদিকে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষিকা বাদি হয়ে জামেয়া আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মহিলা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আলতাফুর রহমান সাদিকীকে আসামি করে মৌলভীবাজার সদর মডেল থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু আওয়ামী ঘরাণার নেতাদের আর্শীবাদের হাত আলতাফুর রহমানের মাথার উপর থাকায় তাদের প্রভাবে পুলিশ ওই অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ বা আটক করেনি মাওলানা আলতাফুর রহমান সাদিকীকে। ওই সময়ে জেলার শীর্ষ আলেমরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অবশেষে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১ অক্টোবর রাতে মৌলভীবাজার সদর মডেল থানায় মাওলানা আলতাফুর রহমানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী শিক্ষিকা। তার দায়ের করা মামলার ভিত্তিতে ২ অক্টোবর সকালে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার এক আলেম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আলতাফুর রহমান সাদিকী আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতেন সব সময়। এমনকি আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের নির্বাচনী সভাগুলোতেও তার সরব উপস্থিতি ছিল। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পদ রক্ষা ও ধর্ষণের ঘটনা থেকে নিজেকে বাঁচাতে আওয়ামী ঘরাণার নেতা ও আলেমদের সাথে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল। তাকে সার্বিক সহযোগিতা করতেন জেলার আওয়ামী দালাল খ্যাত কয়েকজন মাওলানা। শুধু ভুক্তভোগী শিক্ষিকা নন, আরো কয়েকজন শিক্ষিকা আলতাপুর রহমানের লালসার শিকার হন। তাকে গ্রেপ্তারে জেলাব্যাপী কওমি অঙ্গনে খুশির জোয়ার বইছে। তার সহযোগিদের দ্রæততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোড়ালো হচ্ছে।’

এদিকে মাওলানা আলতাফুর রহমান সাদিকী গ্রেপ্তারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে চলছে উৎফুল্লতা। মাওলানা শেখ ফজলুর রহমান তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছেন ‘আওয়ামী লীগের দালাল ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ও বাটপার মঈনুল হক চৌধুরীর পা চাটা গোলাম নারী ধর্ষণকারী আলতাফুর রহমান সাদিকী গ্রেপ্তার।’ মাওলানা শেখ নুরে আলম হামিদী নিজের ফেসবুক টাইমলাইনে মন্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘মাদ্রাসা থেকে তাকে অব্যাহতি প্রদানের পর স্বৈরাচারের গুন্ডা বাহিনী আর লেবাসধারী কিছু দালাল তাকে আবার নিয়ে এসেছিল।’ আহমেদ আল আমিন তার ফেসবুক টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, সত্যের জয় সুনিশ্চিত। আলতাফের গ্রেপ্তারে আনন্দিত।’ ওই মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ও মৌলভীবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আয়াছ আহমদ নিজের টাইমলাইনে একটি স্টিকার পোস্ট করেন। ওই স্টিকারে গ্রেপ্তারকৃত আলতাফুর রহমান সাদিকীসহ চার জনের ছবি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মৌলভীবাজার জেলার স্বৈরাচারের দোসর, চিহ্নিত পা চাটা দালাল, চাঁদাবাজ, অর্থ আত্মসাৎকারী, নারী কেলেঙ্কারীর সাথে জড়িত মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, ক্বারী শামসুল হক, মঈনুল হক চৌধুরী, আলতাফুর রহমান সাদিকীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’

জামেয়া আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মহিলা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আলতাফুর রহমান সাদিকী গ্রেপ্তারের বিষয়ে মৌলভীবাজার সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গাজী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগে আলতাফুর রহমান সাদিকীকে গ্রেপ্তার করে বুধবার (২ অক্টোবর) দুপুরে মৌলভীবাজার আদালতে পাঠানো হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত আসামিকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন।’