Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
জন্ম থেকেই দৃষ্টিহীন হরিবল বোনার্জী। তার আবাস মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা হুগলিছড়া চা বাগানে। জন্ম থেকেই অন্ধ হরিবল এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে অংশ নিয়ে পেয়েছেন জিপিএ-৫। ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায়ও তিনি জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। মেধাবী হরিবল বোনার্জী হুগলিছড়া চা বাগানের শ্রমিক অনিল বোনার্জী ও বিশোখা বোনার্জীর পুত্র। তার বড়বোন অঞ্জলি বোনার্জীর বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি রয়েছেন স্বামীগৃহে। আর সর্বকনিষ্ট বোন রুবি বোনার্জী ভাই হরিবলের সাথেই এবারের এইচএসসিতে অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) বিকেলে প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপকালে হরিবল বোনার্জী বলেন, ‘আমার গল্পটা অনেক করুণ। ২০০৮ সালে আমার পরিবার আমাকে প্রাইমারিতে ভর্তি করে। সে সময়ে আমি পড়াশোনা যে করতে পারবো তার নিশ্চয়তা ছিল না। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে আমাকে ভর্তি করা হয়। ব্র্যাকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের যে পদ্ধতি অর্থাৎ ব্রেইল পদ্ধতি ছিল না। সে কারনে ভর্তির পর তিন বছর আমি লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হই। ২০১২ সালে মূলত আমার আনুষ্ঠানিক পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয়। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত পিএসসি পরীক্ষায় (প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী) জিপিএ ৪.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হই এবং সাধারণ বৃত্তি লাভ করি। তারপর ২০১৭ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। সেখান থেকে ২০১৯ সালে জেএসসি পরীক্ষায় (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা) জিপিএ ৪.৮৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হই এবং ২০২২ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় (মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা) জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। পরবর্তীতে আমি মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে ভর্তি হই। আমার লেখাপড়াটা সম্পূর্ণই আমার উপরই নির্ভর ছিল। মানে আমরা যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী আমাদের পড়াশুনা করতে হয় ব্রেইল পদ্ধতিতে। আমাদের বইগুলো থাকে একটু ভিন্নরকম। এই ধরণের বইগুলো সরকার শুধুমাত্র মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ছাপায়। মাধ্যমিক পরবর্তী পর্যায়ের বইগুলো সরকারিভাবে ছাপানো হয় না। যার কারনে আমরা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে সরকারিভাবে পড়াশুনার সুযোগটা পাই না। তবুও আমি মৌলভীবাজার সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় পড়াশুনা করি সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে। থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাই ইন্টার লেভেলের জন্য। কলেজ জার্নি যখন শুরু হয় সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের সহযোগিতা পাই আমি। তবে নবম-দশম লেভেলে ব্র্যাকের কর্মকর্তা শ্রদ্ধেয় লিমি আপা (লিমিয়া দেওয়ান) যিনি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করতেন এখন অবসরে আছেন তিনি আমাকে সহযোগিতা না করলে হয়তো আমি এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেতাম না। তিনি আমাকে একটি স্মার্টফোন কিনে দেন। এ স্মার্টফোনে আমি আমার দৈনন্দিন পড়া রেকর্ড করে সেই রেকর্ড বাজিয়ে মুখস্ত করতাম। এরপরও লিমি আপা আমাকে আরো নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া আমাদের চা বাগানে শিশুদের পড়ালেখা করাতেন পার্শ্ববর্তী আমরাইলছড়া চা বাগানের বাসিন্দা শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আপন দাস। তিনি আমাকে অনেক দুর থেকে এসে দীর্ঘদিন বিনা বেতন প্রাইভেট পড়িয়েছেন। আমার এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টে উনার সহযোগিতাও কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি। এছাড়া কলেজে ভর্তির সময় আপন দাস স্যার বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে আমাকে ভর্তি ফিসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। যখন ইন্টার লেভেলে পড়াশুনা শুরু করলাম তখন অনেক ধরণের বাধাবিপত্তিতে পড়তে হয়েছে। এ সময় আমি বই কিনে অন্য কারো সহযোগিতায় রেকর্ড করিয়ে ওই রেকর্ডটা শুনে শুনে পড়তে হতো। একজন শ্রæতিলেখকের সহায়তায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পরীক্ষায় বসতে হয়। শ্রæতিলেখকদের সহায়তা এক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমার ফলাফলের জন্য আমি শ্রæতিলেখকদের কাছেও কৃতাজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সবার দোয়া ও সহযোগিতায় এবং আমার পরিশ্রম মিলিয়ে আমার এ রেজাল্ট। সামনে যেন আরো ভালো পর্যায়ে বা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়তে পারি এবং পরবর্তীতে একটি ভালো চাকরী করে যেন পরিবারের হাল ধরতে পারি সেজন্য সকলের কাছে দোয়া-আর্শীবাদ কামনা করছি।’
হরিবল বোনার্জীর বাবা অনিল বোনার্জী বলেন, ‘আমি হুগলিছড়া চা বাগানের একজন চা শ্রমিক। আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই অনেক চেষ্টা করছে। আমারে কইছে (বলছে) বাবা আমি লেখাপড়া করব। তখন আমি জানি না এতটুক লেখাপড়া কিভাবে করবে। সকলের সাহায্য-সহযোগিতায় আমার ছেলেটা লেখাপড়া শিখেছে। এবার গোল্ডেন পেয়ে পাশ করছে। এখন আপনারা আরো সাহায্য-সহযোগিতা করলে আমার ছেলের আরও ভালো হয়।’
হরিবলের প্রতিবেশী হুগলিছড়া চা বাগানের শ্রমিক রাজিব বোনার্জী বলেন, ‘হরিবল প্রতিবন্ধী। ভগবানে দিছে তাইন শিক্ষাগত দিক দিয়া উচ্চ লেভেলে গেছে। সবে (সবাই) আর্শীবাদ করবেন যাতে সে দুইটা বইন (দুটি বোন) আর মা-বাবারে দেখিয়া যাইতো পারে। তার লাগি একটু সরকার দৃষ্টি চোখে (কৃপা দৃষ্টি) চায় এই আমরার (আমাদের) আবেদন সরকারের কাছে।’
হরিবলের প্রাইভেট শিক্ষক আপন দাস বলেন, ‘হরিবল বোনার্জী হুগলিছড়া চা বাগানের ছেলে। সে আমার ছাত্র। তার সাথে পরিচয় মূলত আমি যখন হুগলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি তখন সে আমাদের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে ভর্তি হয়। কিন্তু আমাদের সেই স্কুলে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্তা না থাকায় সহকর্মী ও আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অভিজিৎ দেবরায় স্যার এবং পঙ্কজ কান্তি ভট্টাচার্য স্যার উনারা মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে হরিবলকে সেখানে ভর্তি করেন। সেখান থেকেই আমাদের হরিবলের পথচলা শুরু। সে মৌলভীবাজারে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে এবং এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পায়। তারপর সে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। সেখান থেকেও সে সফলতার সাথে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। হরিবলের স্বপ্ন হচ্ছে সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করবে। আর এজন্য দরকার তার একটা ভালো পজিশনে যাওয়া। সে বর্তমানে ভার্সিটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলআপ, সে লিখতে পারে না সেজন্য একজন শ্রæতিলেখক প্রয়োজন। সে যখন ভর্তি পরীক্ষা দেবে তখন শ্রæতিলেখকের থাকা-খাওয়া, ভাড়া মিলিয়ে ভালো একটা খরচ আসবে। সমাজের বিত্তবান বা প্রতিষ্ঠিত আছেন আমি তাদের সবাইকে অনুরোধ করবো যেন এই সময়ে আমরা হরিবলের পাশে দাঁড়াতে পারি।’
৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) সঞ্জিত বোনার্জী বলেন, ‘হরিবল মানুষটা কিন্তু অনেক অসহায়। তার ফ্যামেলি অনেক অসহায়। তার বাবা-মা দিন আনে, সপ্তাহে একবার তলব (সাপ্তাহিক বেতন) পায় এইটা দিয়ে অনেক কষ্ট হয় তাদের চলতে-ফিরতে। হরিবল যেটা করেছে তা আমরার (আমাদের) গর্বের বিষয়। তাদের পরিবার সরকারিভাবে তেমন কিছু একটা পায় না। তারে (তাকে) যদি সরকারি একটা চাকরী দেয়া যায় তাহলে আমি অনেক কৃতজ্ঞ হবো।’
৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেবাশীষ দেব রাখু বলেন, ‘হরিবল বোনার্জী শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের হুগলিছড়া চা বাগানের একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। আগে সে অনেক কিছুই পাইছে (পেয়েছে) এবং প্রতিবন্ধী হিসেবে আাগমীতেও যাতে পায় তার জন্য সরকারের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি যে তাকে একটু সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়ার জন্য।’