Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার :
কাগজপত্রে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর বা ৩ হাজার ৮৭ দশমিক ৫ একর (২ দশমিক ৪৭ একরে ১ হেক্টর)। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু বনভূমি নিজেদের আওতায় রয়েছে তা জানে না খোদ বন বিভাগই। প্রভাবশালী মহলের বাধা, রক্তচক্ষু ও নানাবিদ কারনে দীর্ঘদিন ধরে বনটির আয়তন পরিমাপ না হবার কারনে বনের চারপাশের জমি যে যেভাবে পেরেছে দখলে নিয়ে সম্প্রসারণ করেছে চা বাগান, তৈরি করেছে লেবু-আনারস বাগান, কটেজ, বাড়িসহ নানা স্থাপনা। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি দখল-বেদখলে ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে প্রায় অর্ধেক আয়তনে এসে দাঁড়িয়েছে বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। ওই সূত্রটি মতে, অনেকবার বনটি ডিমারগেশনের (পরিমাপ) চেষ্টা করেও ডিমারগেশন করা বা বনের জমি দখলে রাখা দখলবাজদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। দখলবাজরা প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগ বা পতিত সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় তাদের প্রভাবের কারনেই বন ডিমারগেশন (পরিমাপ) করা যায়নি। তাদের (দখলবাজদের) ভয়ে বন বিভাগই থাকতো তটস্থ। যে কারনে দখলবাজরা বনের জমি দখলের মচ্ছপে মেতে ওঠে। অবশেষে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে বন বিভাগ প্রভাবশালী মহলের দখলে থাকা লাউয়াছড়া বনের জমি উদ্ধার করা শুরু করেছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সদ্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদের ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামের চা বাগানের দখলে থাকা প্রায় পাঁচ একর জমি উদ্ধারের পর রবিবার (৩ নভেম্বর) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে কমলগঞ্জ উপজেলার ৫ নম্বর কমলগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সদস্য বদরুল আলম জেনারের দখলে থাকা প্রায় চার একর বনভূমি উদ্ধার করেছে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। উদ্ধারকৃত বনভূমিতে বন্যপ্রাণীদের খাবার উপযুক্ত ফলদ বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে।
বন বিভাগ জানায়, রবিার (৩ নভেম্বর) সকাল ৯টায় শতাধিক শ্রমিক নিয়ে কমলগঞ্জ থানা পুলিশের সহায়তায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের হীড বাংলাদেশের পশ্চিম পাশে বনভূমি উদ্ধার অভিযান শুরু করেন তারা। সন্ধ্যায় অভিযান শেষ হয়। অভিযানে উপস্থিত ছিলেন বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান ও রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম। অভিযানকালে দখলদার বদরুল আলম জেনারকে পাওয়া যায়নি।
বন বিভাগ যে চার একর বনভূমি উদ্ধার করেছে সে জমিতে লেবু চাষ করেন জনৈক শাহ আলম। তিনি জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি প্রতিবেদককে জানান, বদরুল আলম জেনারের কাছ থেকে ওই জমি ৫ বছরের লিজ নিয়ে এখানে লেবু চাষ করছেন। অগ্রিম হিসেবে জেনারকে দুই বছরের জন্য এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা দিয়েছেন। বাকিটা টাকা ধীরে ধীরে পরিশোধ করার কথা ছিল।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের জীববৈচিত্রে ভরপুর লাউয়াছড়া বনটিকে সরকার ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করে। ‘রেইন ফরেস্ট’ হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বিখ্যাত। উল্লূক ছাড়াও এ বনে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ জীবজন্তু। জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণার পূর্ব থেকেই বনটিতে দখলের থাবা বসিয়েছে বনটির আশপাশের কিছু কিছু বাসিন্দা। নিজেদের জমির সাথে বনের ভূমি দখলে নিয়ে বনের আশপাশের বাসিন্দারা বাড়িঘর তৈরি ও লেবু-আনারস বাগানের সীমানা বর্ধিত করলেও প্রকৃতপক্ষে দখলের মচ্ছব শুরু হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে। সদ্যসাবেক কৃষিমন্ত্রী ও মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের সাত বারের সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ২০০৯ সালে পূর্ণমন্ত্রী মর্যাদায় জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ মনোনীত হন। সে সময়ে তিনি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের স্টুডেন্ট ডরমিটরির পাশে কিছু জমি স্বল্পমূল্যে কিনে ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে একটি চা-বাগান গড়ে তোলেন। সে সময়েই অভিযোগ ওঠে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মো. আব্দুুস শহীদ নিজের কেনা স্বল্প জমির সঙ্গে লাউয়াছড়া উদ্যানের অনেকটা দখল করে ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশনে’ যুক্ত করেছেন। সে সময় থেকেই বন বিভাগ বারবার বনের জমি পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েও পরিমাপ করতে পারেনি। এরপর থেকেই মূলত লাউয়াছড়া বনভূমি লুটেপুটে খেতে শুরু করে প্রভাবশালীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমলগঞ্জের এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘রক্ষিত বন এলাকার সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও তেমনি কমিটি কাজ করছে। এ কমিটি প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থা, সংঘবদ্ধ চμের মাধ্যমে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান হতে বৃক্ষ নিধন ও পাচার রোধ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহলের মাধ্যমে বনভূমির অব্যাহত বেদখল বা জবর দখল রোধসহ বেশ কয়েকটি কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। কিন্তু কমিটির একজন সদস্য (সাবেক) থাকাবস্থায় বদরুল আলম জেনার বনভূমি দখল করে নিয়েছেন। এছাড়া বনভূমি দখল করেছিলেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ। এককথায় বলা যায় লাউয়াছড়া বনের ক্ষেত্রে ‘রক্ষকই ভক্ষক’। যারা বনভূমি দখল করেছিলেন প্রচলিত আইনে তাদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’
রবিবার (৩ নভেম্বর) অভিযানের ব্যাপারে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দখলে থাকা ৫ একর বনের জমি উদ্ধারের পর ৩ নভেম্বর জনৈক বদরুল আলম জেনারের দখলে থাকা আরো ৪ একর বনভূমি আমরা উদ্ধার করেছি। ঠিক কতটুকু জমি এখনো প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে তা অনুমান করা কঠিন। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জমি দখলবাজদের চিহ্নিত করার কাজ চলমান। দ্রæততম সময়ের মধ্যে লাউয়াছড়া বন ডিমারগেশন (পরিমাপ) করা হবে। ডিমারগেশন সম্পন্ন হলে প্রকৃত চিত্রটা জানা যাবে।’
বন্যপ্রাণী ও প্রকৃৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে আমরা প্রায় ৪ একর বনের জমি উদ্ধার করেছি। তবে উদ্ধারের সময় কাউকে পাইনি। কেউ এ জমির মালিকানা দাবী করতেও আসেনি।’
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা গত ১৫ সেপ্টেম্বর বনের ৫ একর জমি উদ্ধারের পর ৩ নভেম্বর আরো ৪ একর জায়গা উদ্ধার করেছি। আমরা সেই জায়গাগুলোতে বন্যপ্রাণীর উপযোগী গাছের চারা লাগিয়েছি।’