Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
তিনি ছিলেন একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি উপজেলা ও জেলার সর্বত্র যাতায়াত করতেন একটি ভংগুর ৫০ সিসি মোটরসাইকেলে। পৈত্রিক সম্পদের বাইরে তার বড় সম্পদ বলতে ছিল ওই মোটরসাইকেলটিই। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগে শুরু হয় টানাপোড়ন। দলের অভ্যন্তরে দ্বন্ধ-সংঘাত চরম আকার ধারণ করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তাকে টেনে নিয়ে আসেন সক্রিয় রাজনীতির ময়দানে এবং তিনি পেয়ে যান দলীয় মনোনয়ন। আর ওই মনোনয়নই ঘুরে যায় তার ভাগ্য আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাকা। চা বাগান অধ্যুষিত আওয়ামী লীগের শক্ত দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে প্রথমবার নির্বাচিত হন। এরপর ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত মোট সাত বার সংসদ সদস্য পদে আসীন ছিলেন। ওই সাত বারে সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় মোট ৩৩ বছরে অনিয়ম আর দুর্নীতির চাদর মুড়িয়ে তিনি হয়েছেন শত কোটি টাকার মালিক। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বলছি সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুস শহীদের কথা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩৩ বছর ধরে সংসদ সদস্য পদে আসীন থাকায় এবং ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত এবং ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে তিনি ওই সময়কালে লাউয়াছড়া বনের জমি দখল করে চা বাগান নির্মাণ, বাগান বাড়ি নির্মাণ, হাইল-হাওরে মৎস্য খামার, রাজধানীর উত্তরায় ১০ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডে বাসা, ফ্ল্যাট ও প্লট, ফার্মগেট এলাকায় জমি কিনে ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া, হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার জগদিশপুরে পেট্রোল পাম্প, শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের দিলবরনগর এলাকায় ৬ একর জমিতে লেবু বাগান, শ্রীমঙ্গল হাউজিং এস্টেটে জমি, মেয়ে উম্মে ফারজানা ডায়নার নামে কমলগঞ্জ উপজেলার মাঝেরছড়া এলাকায় কয়েকশ একর টিলা-ভূমিসহ নিজের ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে সম্পদের পাহাড় গড়েন তিনি।
তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা গেছে, কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ডরমেটরির পাশে তিনি স্বল্পমূল্যে চার একর জমি কিনে এবং লাউয়াছড়া উদ্যানের পাঁচ একর জমি জোরপূর্বক দখল করে ২০১৮ সালে তিনি গড়ে তুলেন ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশন’ নামে একটি চা বাগান। ওই সময়ে সরকারি খরচে পুরো চা বাগানজুড়ে পল্লী বিদ্যুতের লাইন টেনে বিদ্যুৎ সংযোগ নেন। এছাড়া ওই বাগানের সেচের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সরকারি ১৬টি গভীর নলকূপও তিনি স্থাপন করেন। একইসাথে কমলগঞ্জের কাঁঠাল কান্দি পাহাড়ি এলাকায় প্রায় আট একর জমিতে তিনি নির্মাণ করেন একটি বাগানবাড়ি। সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ ওই বাগানবাড়িতে সরকারি খরচে একাধিক গভীর নলকূপ স্থাপন এবং বিদ্যুতের জন্য আটটি সৌর প্ল্যান্ট নির্মাণ করেন। শ্রীমঙ্গলের মৎস্য অয়ভাশ্রম বাইক্কাবিলের পাশে প্রায় ১১ একর জমি নিয়ে আব্দুস শহীদ গড়ে তুলেন বিশাল মৎস্য খামার। দিলবরনগর এলাকায় লেবু বাগানে সরকারি ১১টি ডিপ টিউবওয়েল, শুধুমাত্র তার বাগানে প্রবেশে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) থেকে সরকারি খরচে ব্রিজ, গাইড ওয়াল, আরসিসি ঢালাই রাস্তা নির্মাণ করেছেন তিনি। এছাড়া শ্রীমঙ্গল শহরের কলেজ রোডে নিজের পাঁচতলা ভবনের নিচ তলায়, মৌলভীবাজার রোডস্থ হাউজিং এস্টেটে নিজের জমিতে সরকারি গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন তিনি। একইসাথে কমলগঞ্জ উপজেলা সদরে তার নতুন বহুতল ভবনে সরকারি খরচে গভীর নলকূপ এবং সোলার লাইট স্থাপন করেছেন।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের দখলে থাকা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাঁচ একর জমি উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। এ জমিতে বন্যপ্রাণীর খাবার উপযোগী প্রায় পাঁচ হাজার ফলের চারা রোপন করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজার রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আগে বন বিভাগের পক্ষ থেকে বহু চেষ্টা চালিয়ে বনের জমি সাবেক কৃষিমস্ত্রীর দখল থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গত ১৫ সেপ্টেম্বর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাঁচ একর জমি জবরদখল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।’
সরকারি খরচে সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদের মালিকানাধীন ‘সাবারী টি প্ল্যান্টেশনে’ পল্লী বিদ্যুতের লাইন টেনে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যাপারে মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ. বি. এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের নামে এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়।’
সাবেক কৃষিমন্ত্রীর মালিকানাধীন সাবারী টি প্ল্যান্টেশন, লেবু-আনারস বাগান, বাড়ি ও বাগানবাড়িতে সরকারি খরচে পয়ত্রিশটির মতো গভীর নলকূপ স্থাপনের ব্যাপারে মৌলভীবাজার জস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদুজ্জামান বলেন, ‘সাবেক কৃষিমন্ত্রীর চা বাগান ও বাগানবাড়িতে সরকারি ডিপটিউবওয়েল স্থাপনের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে দেখছি। সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
স্ত্রীর নামে বাড়ি রয়েছে কানাডার বেগমপাড়ায়
সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে বন বিভাগের জমি দখল করে চা-বাগান তৈরি, সরকারি খরচে চা-বাগানের রাস্তার লাইট ও ডিপটিউবওয়েল বসানো ছাড়াও আইন লঙ্ঘন করে নানা দুর্নীতি-অনিয়মের প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। গত ৮ সেপ্টেম্বর দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আখতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, তদন্তে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রী ও সন্তানদের নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়ি-ফ্ল্যাট ও অন্যান্য সম্পদের তথ্য উঠে এসেছে। কানাডার ‘বেগমপাড়া’য়ও তার স্ত্রীর নামে একটি বাড়ি ও দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ রয়েছে।
২০১২ সালে নিজের বাড়িতে সরকারি গ্যাস লাইন ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করার পর মো. আব্দুস শহীদ মন্ত্রী মর্যাদায় জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ মনোনীত হন। ২০১২ সালে তৎকালীন চিফ হুইপের আবদার মেটাতে গিয়ে বিধি লঙ্ঘন করে জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি কমলগঞ্জের আদমপুরে অবস্থিত সাবস্টেশন থেকে আব্দুস শহীদের বাড়ি রহিমপুর ইউনিয়নের সিদ্ধেশ্বরপুর গ্রাম পর্যন্ত আট কিলোমিটার দীর্ঘ একটি গ্যাস পাইপ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে তার গ্রামের বাড়িতে গ্যাস সংযোগ দেয়। কোম্পানির বিধি মোতাবেক নতুন গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে পাইপ লাইন বসাতে হলে তার ব্যয়ভাব গ্রাহককে বহন করতে হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকার দলীয় চিপ হুইপ আব্দুস শহীদের আবদার মেটাতে কোম্পানিটি বিধি লঙ্ঘন করে তাদের খরচে পাইপ লাইন স্থাপন করে। এতে কোম্পানির প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়।
জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তৎকালীন সময়ের জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ স্বাক্ষরিত চাহিদাপত্র পাওয়ার পর কোম্পানির পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সরেজমিনে পাইপ লাইনটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আট কিলোমিটার দীর্ঘ ওই পাইপলাইন স্থাপন করা হলে ৫০-৬০ জন আবাসিক গ্রাহক, ৪/৫জন বাণিজ্যিক গ্রাহক এবং ২/১টি কুটিরশিল্প গ্যাস-সংযোগের আওতায় আসতে পারে। ফলে পাইপলাইনটির মাধ্যমে গ্যাস-সংযোগের আওতা বাড়ানো কোনভাবেই লাভজনক হবে না। তাই এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যয়ভার গ্রাহকের বহন করার বিধি পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করা উচিত। কিন্তু ওই প্রতিবেদন উপেক্ষা করে প্রতিবেদনটি দাখিলের আড়াই মাসের মাথায় আরেকটি কমিটি করে ওই কমিটিকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দ্বিতীয় কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পাইপ লাইনটি স্থাপিত হলে প্রায় ২০০ আবাসিক ও ২০ জন বাণিজ্যিক গ্রাহক সংযোগের আওতায় আসবেন। অদূর ভবিষ্যতে গ্রাহকসংখ্যা আরও বাড়বে। ২০১২ সালের ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের ৩০৯তম সভায় প্রতিবেদনটি গ্রহণ করা হয় এবং পাইপ লাইনটি স্থান করা হয়।
এ ব্যাপারে কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনুচ্ছুত কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১২ সালে ৮ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন প্রকল্পটি একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। এ ধরনের প্রকল্পের কারণে সেবাধর্মী রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো ক্রমাগত লসের মুখ দেখে।’
সাবেক কৃষিমন্ত্রীর দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে যা বলেন স্থানীয়রা সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মৌলভীবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক জহর লাল দত্ত বলেন, ‘শুধু আব্দুস শহীদই না। পুরো দেশে গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবাধে লুটপাট করেছে। নজিরবিহীন এ লুটপাটের বিচার করতে হবে এবং দেশের বাইরে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।’
বামফ্রন্ট নেতা বিশ্বজিৎ পাল বলেন, ‘বিগত অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাধারণ মানুষ মুখ খুলে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। সাবেক এ মন্ত্রী কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলে উপজেলা পর্যায়ে লুটপাটের বাহিনী তৈরি করেছিলেন। তদন্ত করলে তা বেরিয়ে আসবে। আমরা সকল লুটপাটের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।’
সাবেক কৃষিমন্ত্রীর গ্রেপ্তারে নিজ এলাকায় মিষ্টি বিতরণ।গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) রাতে উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে নিজ বাড়ি থেকে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদকে গ্রেপ্তার করে। আব্দুস শহীদের গ্রেপ্তারের খবরে পরদিন ৩০ অক্টোবর তার নির্বাচনী এলাকা শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে বিএনপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা বিএনপির সভাপতি নুরুল আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘সাবেক কৃষিমন্ত্রী দীর্ঘ ১৬ বছরে বিএনপির নির্বাহী কমিটি সদস্য হাজী মুজিবুর রহমান চৌধুরীকে ১৩৪টি মামলা দিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন করেছেন। তিনি বিগত ১৬ বছর এলাকায় বিএনপি কোন মিটিং ও মিছিল করতে পারেনি। বিএনপির ইফতার মাহফিলে তার সন্ত্রাসী বাহিনী হামলা ও ভাংচুর চালায়। শুধু বিএনপি নেতাকর্মীই নন, সাধারণ মানুষও সাবেক কৃষিমন্ত্রীর কাছ থেকে নিরাপদ ছিলেন না। তাই তার গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষও আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন।’