Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ:
আদিকাল থেকেই নৃ-তাত্তি¡ক জনগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য তার প্রাকৃতিক যা কিছু সম্পদ সবই তাদের দেবতাদের সৃষ্টি। দেবতা মিসি সালজং পার্থিব ফসলাদি এবং সুষিমি রোগ নিরাময়কারী ও ঐশ্বর্য প্রদানকারী। তাই এসব দেবতার দানকৃত সম্পদ বা ফসলাদি ব্যবহার করার আগে গারো সম্প্রদায় তাদের উৎপাদিত ফসলাদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। দেবতাদের উৎসর্গ করা ছাড়া গারোরা তাদের ফসল ব্যবহার করেন না। ফসল উৎসর্গের এই আনুষ্ঠানিকতাই হলো ‘ওয়ানগালা উৎসব’ বা গারো নবান্ন উৎসব। এটি গরোদের প্রধান উৎসব। এবারের উৎসবের আয়োজন করে ওয়ানগালা উদযাপন কমিটি।
রবিবার (১ ডিসেম্বর) মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নের ফুলছড়া চা বাগানের গারো লাইন মাঠে দুই দিনব্যাপী ‘ওয়ানগালা’ উৎসবের শেষ দিনের অনুষ্ঠানমালা অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা অনুষ্ঠিত হয়। রবিবার উৎসবের শেষ দিনে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ ওয়ানগালার মূল প্রবন্ধ পাঠ, নাগড়া, আদুরী, দামা ও মোমবাতি প্রজ্বলন, বিশেষ প্রার্থনা এবং গারোদের নিজস্ব কৃষ্টির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান পুরোহিত জংসন মৃ সমাপনী দিবসের সকালে প্রথা অনুসারে একটি মোরগ জবাই করে তার ভেতর থেকে ভুরি বের করেন। এরপর মন্ত্র পড়ে ভবিষ্যত গণনা করে জানান, ‘আগামী বছর ফসল দ্বিগুন হবে। আসছে দিনগুলো সবার জন্য শুভ হয়ে দেখা দেবে। দাম্পত্য জীবন সুখের হবে’। প্রধান পুরোহিত জানান, আগের দিনে গারো পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ হতো এবং বছরে মাত্র একটি ফসল হতো। তখন ওই জুম বা ধান ঘরে ওঠানোর সময় গারোদের শস্যদেবতা ‘মিসি সালজং’-কে উৎসর্গ করে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। গারোরা প্রকৃৃতিপূজারী। কালের পরিক্রমায় গারোরা ধীরে ধীরে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে করে পালন করা হয়। একসময় তারা শস্যদেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করলেও এখন অনেকে নতুন ফসল কেটে যিশুখ্রিস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ওয়ানগালা পালন করে থাকেন।
উৎসবটি পালন উপলক্ষে গারো সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েরা বিচিত্র পোশাক পরিধান ও পাখির পালক মাথায় দিয়ে লম্বাকৃতি ঢোলের তালে তালে নাচে-গানে মাতিয়ে রাখে। অনুষ্ঠানে রুগালা, গোরীরুয়া, গ্রিক্কা, বিসাদিমদিমা, চাম্বিল মেসা, নকগাখা, চাওয়ারী সিকগা ইত্যাদি শিরোনামের বিষয়গুলো নাচে-গানে উপস্থাপন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজারের তিনটি উপজেলার বিভিন্ন গারো পল্লীর গারাগানজিং, কতচু, রুগা, মমিন, বাবিল, দোয়াল, মাতচি, মিগাম, চিবক, আচদং, সাংমা, মাতাবেং ও আরেং এই ১২টি গোত্রের গারো সম্প্রদায়ের লোকজনসহ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে জেলার বিভিন্ন উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ।