lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Last Updated 2024-12-22T06:15:32Z
জাতীয়

সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ দেশটাকে গোরস্তান কিংবা শ্মশানে পরিণত করেছিল: ডা. শফিকুর রহমান

Advertisement


 

ইসমাইল মাহমুদ:

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ দেশটাকে গোরস্তান কিংবা শ্মশানে পরিণত করেছিল। এরা মাঝে মাঝে বলতো দেশে নাকি অনাবিল শান্তি বিরাজ করছে। আমরা বলতাম শান্তি তোমরা কায়েম করেছো কবরের মতো। যেখান থেকে হাসি কিংবা কান্নার শব্দ শোনা যায় না। কবরস্থানে কোন জীবিত মানুষ থাকে না। তাই হাসি কান্নার আওয়াজ শোনা যায় না। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর তারা লাশের ওপর নর্দন-কুর্দন করেছে। তখনই তারা জানান দিয়েছিল যে ক্ষমতায় এসে খুন-গুমের রাজ্য কায়েম করবে। আমরা সেদিন আমাদের বুকের কান্না বাংলাদেশের মানুষের কাছে হয়তোবা পৌঁছাতে পারিনি।  এরপর পেছনে বোঝাপড়া করে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং একটি জগন্য সরকারে হাত ধরে  করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তারা জয়লাভ করেছিল। ২০০৯ সালের ১০ জানুয়ারি ক্ষমতায় বসে খুনের নেশা বাস্তবায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়। প্রথমে তারা ২৫ এবং ২৬ ফেব্রæয়ারি পিলখানায় খুন করে সেনাবাহিনীর চৌকস ৫৭ জন কর্মকর্তাকে। সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয়। বিডিআর বাহিনী ধ্বংস করে সেই বাহিনীর সাড়ে ১৭ হাজার সদস্যকে চাকরিচ্যুত করলো। সাড়ে ৮ হাজারকে জেলে দিলো। জেলের ভেতর সাড়ে ৩শ’র অধিক মারা গেল। আমাদের গর্বের বাহিনী ধ্বংস হলো। ক্ষমতায় যাওয়ার শেষ সিঁড়ি হিসেবে এদের ব্যবহার করে চক্রান্ত করে ধ্বংস করে দিলো। বাহিনীর নাম বদলে বিজিবি রাখা হয়েছে। আগে নাম ছিল বাংলাদেশ রাইফেলস। আর তারা নাম দিয়েছে বর্ডারের চৌকিদার। লগো বদলিয়েছে, ড্রেস বদলিয়েছে। নাম বদলিয়ে ফেলেছে। কারা হত্যাকারী ছিল জাতিকে জানতে দেওয়া হলো না। লুকোচুরি করা হলো। রাতের অন্ধকারে বিদ্যুতের আলো কেড়ে নিয়ে, অন্ধকার করে খুনিদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো। একটা বিশেষ দেশের প্লেন কেন এসেছিল ঢাকায়? এরপর হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল কিভাবে। তার জবাব স্বৈরাচারী সরকাররা না দিলেও একদিন তাদেরকে দিতে হবে। আমরা সেই হত্যাকান্ডের বিচার চাই।’ তিনি শনিবার (২০ ডিসেম্বর) সকালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা শাখার আয়োজনে বিশাল কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন।

ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, ‘আগামির বাংলাদেশকে তরুণদের হাতে তুলে দিতে চাই। সাড়ে ১৫ বছর আমরা দফায় দফায় আমরা অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু সেই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি আমরা ঘটাতে পারিনি। স্বৈরাচারকে আমরা তাড়াতে পারিনি, বিদায় করতে পারিনি। আমি গর্বিত আমাদের সন্তানেরা সেই কাজটি করেছে। আমি আমাদের সন্তানদেরকে ভালবাসা উপহার দিচ্ছি। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জাতির পক্ষ থেকে তাদেরকে স্যালুট জানাচ্ছি। আল্লাহ তায়ালার সাহায্যে তারা অসাধ্য সাধন করেছে। এরকম সন্তান পেয়ে জাতি আজ গর্বিত। ইনশাআল্লাহ আগামির বাংলাদেশ আমরা তাদের হাতেই তুলে দিবে।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি মৌলভীবাজার জেলা আমির ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে এবং জেলা সেক্রেটারি মো. ইয়ামির আলী, সহকারী সেক্রেটারি হারুনুর রশিদের যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপুস্থত ছিলেন কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো. ফখরুল ইসলাম, সিলেট জেলা আমির মাওলানা হাবিুবুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহবায়ক ফয়জুল কবির ময়ূন, হেফাজতে ইসলামীর জেলা নায়েবে আমির অধ্যাপক মাওলানা আব্দুুস সবুর, ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগর সভাপতি শরিফ মাহমুদ এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য ও পল্টন থানা আমীর শাহীন আহমদ খান। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামি হবিগঞ্জ জেলা আমীর ও কেন্দ্রীয় মজলিশে সুরার সদস্য কাজী মাওলানা মখলিছুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলার সাবেক আমীর ও কেন্দ্রীয় মজলিশে সুরার সদস্য দেওয়ান সিরাজুল ইসলাম মতলিব, মো. আব্দুুল মান্নান, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা আমিনুল ইসলাম, ছাত্র শিবিরের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি হাফেজ আলম হোসাইন, শহর শাখার সভাপতি তারেক আজিজ, জামায়াত বড়লেখা উপজেলা শাখার সাবেক আমির মো. কমর উদ্দিন, মৌলভীবাজার পৌর শাখার আমির ও জেলা কর্মপরিষদ সদস্য হাফেজ মাওলানা তাজুল ইসলাম, জেলা কর্মপরিষদ সদস্য ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলা আমির মো. ফখরুল ইসলাম, বড়লেখা উপজেলা আমির মো. এমদাদুল ইসলাম, রাজনগর উপজেলা আমির আবু রাইয়ান শাহীন, কুলাউড়া উপজেলা আমির অধ্যাপক আব্দুল মুনতাজিম, জুড়ী উপজেলা আমির আব্দুল হাই হেলাল, শ্রীমঙ্গল উপজেলা আমির মাওলানা ইসমাঈল হোসেন, কমলগঞ্জ উপজেলা আমির মো. মাসুক মিয়া প্রমুখ। 

সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠান শুরু হলেও ভোর থেকে জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন ইউনিটের কর্মীরা ঘন কুয়াসা ও শীত উপেক্ষা করে জড়ো হতে থাকেন মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। নির্ধারিত সময়ের আগেই কর্মী সস্মেলনটি জনসভায় রূপ নেয়। দলের আমির নির্বাচিত হবার পর তাঁর নিজ জেলা মৌলভীবাজারে এবারই প্রথম খোলা মাঠে কর্মী সম্মেলনে বক্তব্য রাখলেন জামায়াতে ইসলামি আমির ডা. শফিকুর রহমান।

প্রায় ২৪ মিনিটের বক্তব্যের শুরুতে জামায়াতের আমির জুলাই আন্দোলনের বীর সৈনিকদের একটি ¯েøাগান উচ্চারণ করে বলেন ‘বুকের ভিতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর। দেশের ছাত্রজনতার ক্ষোভটা ছিল সাড়ে ১৫টা বছর। এসময়টায় আওয়ামী লীগ জাতির ঘাড়ে বসে সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছিল।’ 

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. শফিকুর রহমান আরো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই যখন আমাদের উপর নির্যাতনের ষ্টিম রোলার চালালো আমরা তখন আমাদের বন্ধু ও সমমনা সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠনকে বলেছিলাম এটি জামায়াতের ওপর আঘাত নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের এই বিশাল দেওয়াল ভেঙ্গে দিলে বাকিরা সবাই ভেসে যাবেন, কেউ টিকতে পারবেন না। আমাদের পাশে দাঁড়ান। ফ্যাসিজমকে সম্মিলিতভাবে আমরা মোকাবেলা করি। আমরা কথাগুলো বুঝাইতে পারি নাই। সবাই মিলে একসাথে সেই যুদ্ধটা করতে পারলাম না। তারপরের ইতিহাস আপনাদের সামনে পরিষ্কার। তারা আর কাউকে ছাড়লো না। এক এক করে সবাইকে ধরলো। বিএনপিকে ধরলো, হেফাজককে ধরলো, আলেম ওলামাকে ধরলো, অন্যান্য দলকে ধরলো। কাউকে তারা ছাড় দিলো না। এমনকি এইযে সাংবাদিক বন্ধুরা আজকে এসেছে নিউজ কাভার করতে; তাদেরকেও ধরলো। তাদেরকে খুন করলো, তাদেরকে আমাদের সাথে গুম করলো। তাদের আয়না ঘরে পাঠালো। কাউকে কাউকে ভারতের ওপাড়ে বর্ডারে নিয়ে ফেলে দিলো। এভাবে তারা সারাটা দেশকে নরকে পরিণত করেছিল। আজকে যুবকরা বলতেছে আমাদের ভোট চুরি করেছিল। তিনটা নির্বাচন আজ যাদের বয়স ৩০-৩২ বছর; তারা একটা ভোটও দিতে পারেনি। তাদের সমস্ত ভোটকে জেনুসাইড করেছিল, গণহত্যা করেছিল। ভোটের গণহত্যা। এদের নৈতিক সাহস ছিল না দেশে থাকার। এজন্য দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। পালাতে গিয়ে কারো কারো অবস্থা এমন হয়েছিল যে, রসিক সিলেটবাসী তাদের কলাপাতায় শুয়ে দিয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেছে আপনি কে গো? বলে যে, আমি শামছুদ্দিন চৌধুরী। স্যার-আপনি কি কালো মানিক? বলে জি¦ জি¦ কালো মানিক। আপনি কোথায় আছেন? সম্ভবত ভারতে আছি। কয় না গো জাদু আপনি যেতে পারেন নাই! কি দুর্ভাগ্য সুপ্রীম কোর্টে অ্যাপিলিয়েট ডিভিশনের একজন বিচারপতি। তিনি এতটাই দলবাজ ছিলেন; লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে ন্যায় বিচার করতে পারেননি। আসল বিচার হবে হাশরে। দুনিয়াতেও কিছু বিচার হয়ে যায়। এসমস্ত খুনি সন্ত্রাসী রাজনীতিবিদ নয়। এদের বিচার বাংলার মাটিতে করতে হবে। প্রত্যেকটা অন্যায় অপরাধের বিচার করতে হবে। জাতিকে এরা ৫৩ বছর বিভিন্ন কায়দায় ফ্যাসিজমের মাধ্যমে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি, মেজরিটি শক্তি, মাইনরেটি শক্তি, কতভাবে যে ভাগ করেছে এরা। কারণ একটা জাতিকে যখন টুকরা টুকরা করা যায়, তখন তাদের গোলাম বানানো সম্ভব। এরা ধরে নিয়েছিল তারা দেশের মালিক, আমরা সবাই ভাড়াটিয়া। হ্যাঁ মালিকরাই দেশে আছে ভাড়াটিয়ারা পালিয়ে গেছে।’

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশকে বলতে চাই আপনারা শান্তিতে থাকেন, আমাদেরকেও শান্তিতে থাকতে দেন। আপনাদের পাক ঘরে কি পাকাবেন আমরা জিজ্ঞেস করি না। আমাদের পাক ঘরে উকি মারার চেষ্টা করবেন না। নিজেরা আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখুন। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবক দিতে হবে না।’

গত সাড়ে ১৫ বছরের ইতিহাস টেনে জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, ‘গত সাড়ে ১৫ বছরে আমাদের শীর্ষ ১১ নেতাকে খুন করা হয়েছে। সবগুলো অফিস তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আমাদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বেদিশা হয়ে শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ পর্যন্ত করা হয়েছে। এতে যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বলেছি দেশকে আমরা ভালবাসি, দেশের মানুষকে আমরা ভালবাসি।’

নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘চাইলে আমরা কিছু কিছু চাঁদাবাজি করতে পারতাম। কিছু দখল নিতে পারতাম। কিন্তু এটা আমাদের জন্য হারাম মনে করি। প্রিয় বাংলাদশে গড়তে জামায়াতে ইসলামির কর্মীদের আরও ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হবে। আমরা একটা সাম্যের বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। বৈষম্যকে নির্বাসনে পাঠাবো। আমরা মেধার স্বীকৃতি প্রদান করবো। পলিটক্রেসি নয় মেরিটক্রেসির ভিত্তিতে জাতি গঠন করবো। যুবকদেরকে শিক্ষা দিয়ে বেকারের হাত বাড়াবো না, যুবকদের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করবো।’

উল্লেখ্য, পতিত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ দমন-নিপীড়ন আর হয়রানিমূলক মামলা ও হামলায় অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের মতো কোনটাসা অবস্থায় ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরাও। ওই সময়কালে জেলায় প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেননি তারা। ৫ আগস্টের গণঅভূত্থানের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করায় সারাদেশের ন্যায় মৌলভীবাজার জেলায়ও জামায়াতে ইসলামী ব্যাপক সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা শুরু করেছে। গত অক্টোবর মাসে জামায়াতে ইসলামীর জেলা কমিটি নির্বাচন ও পুনর্গঠন করা হয়। এরপর একে-একে জেলার সকল উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটির নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়। জেলার সব কয়টি শাখা কমিটি নির্বাচন ও গঠনের পর শনিবার বিশাল জেলা কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।