lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
Last Updated 2024-12-16T14:25:35Z
সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

বাংলার লোকসংস্কৃতিতে স্বর্ণাক্ষরে রবে পাগল হাসানের নাম -সুমন রানা

Advertisement


 


যুগে যুগে বহু মরমি সাধকের আগমন ঘটেছে লোক সংস্কৃতিতে। কুষ্টিয়ার ফকির লালন ,বৃহত্তর ময়মনসিংহের রশিদ উদ্দিন, জালাল উদ্দিন খাঁ, চাঁন মিয়া, উকিল মুন্সী, সিলেটে হাছন রাজা, রাথা রমন, ফকির, শিতালং শাহ, সৈয়দ শাহ্ নূর দূরবীন শাহ, শাহ্ আব্দুল করিম প্রমুখ। যাদের পদচারণায় সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলার লোকসংস্কৃতি।


লোক সংস্কৃতিতে অবদানের ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে আসবে সুনামগঞ্জ জেলার নাম। যে জেলায় হাছন রাজা, রাধারমণ দূরবীন শাহ, শাহ্ আব্দুল এর মতো সাধকের জন্ম। মূলত শাহ্ আব্দুল করিমের মৃত্যুর পর কিছু টা অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে সুনামগঞ্জের লোকসংস্কৃতি। তথা বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি। ঠিক এ সময়ই আগমন ঘটে সুরমা নদীর কুল ঘেঁষা ছাতক উপজেলায় বেড়ে উঠা এক দুরন্ত বালকের। সে বালক আজকের মতিউর রহমান হাসান ওরফে মরমি সাধক পাগল হাসান ।


পাগল হাসানের জম্ম ১জুন ১৯৮৫ সালে। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার এক দরিদ্র পরিবারে। পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা দিলশাদ ও জননী গৃহিণী আমেনা বেগম। পাগল হাসানের দুর্দশার জীবন শুরু হয় শিশু কালে একমাত্র ভাই ও পিতাকে হারিয়ে। মরণব্যাধি ক্যান্সারে পিতার মৃত্যুর পর মা আমেনার আদরে বড় হতে থাকেন হাসান। পাগল হাসানের জীবনদশায় তার কয়েকটা সাক্ষাৎকার থেকে যতটুকু জানা যায়, তিনি দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে ছিলেন। বাল্য বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি ফিরলে বাল্য বন্ধুরা মা আমেনার কাছে নালিশ দিলে মা আমেনা বিনয়ের সাথে বলতেন— ‘আমার পাগলা বেটারে কিচ্ছু ব‌ইলো না ওই তো পাগলা, আমি ওরে শাসন করমুনি, তোমরা যাও।’ মা ভক্ত ছেলে হাসান মা আমেনা কে তার মুর্শিদ বলে সম্বোধন করতেন (পরম শান্তি পাইমু মাগো তোমার কুলে মরিলে)। অকালে বিধবা মা আমিনার ত্যাগ, আদর শাসন পাগল হাসান হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।


হাসানের শিক্ষা জীবন শুরু হয় শিমুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে। এই বিদ্যালয়কে পাগল হাসান তার ইউনিভার্সিটি বলে থাকেন। শিক্ষা জীবনে মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। যদিও পড়াশোনাটা বেশি দূর এগোয়নি। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার কারণে। ‘জীবন আমার রেল গাড়ির ইঞ্জিন, ভব যাতনার ডাব্বা ল‌ইয়া ঘুইরা বেড়ায় নিশি দিন’—পাগল হাসানের গানে আসে ছোট বেলায়। পিতা হারানোর শোক অন্তর পোষে গুন গুন করে গাইতে থাকতেন সারাক্ষণ। তার গাওয়া প্রথম গান, ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’। গানটা তিনি শিখে এসেছিলেন তার নানা বাড়ি থেকে, ঘুমন্ত পিতাকে জাগিয়ে শুনিয়েছিল, তাতে পিতার মন গলাতে পারেননি, পিতার চাওয়া ছিল গানে দেশের কথা থাকতে হবে, দেশপ্রেম থাকতে হবে। পাগল হাসান স্টেজে প্রথম গান করেন ২০০৬ সালে। সুনামগঞ্জ শিল্পকলার প্রোগ্রামে, তার সংগীত গুরু দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন দার হাত ধরে। গানের কথা, অজানা এক নদীর স্রোতে। পাগল হাসান পুরোদমে লেখায় মনোনিবেশ করেন তার সংগীত গুরু দেবদাস রঞ্জন দার অনুপ্রেরণায়।


একজন গীতিকার সুরকার হিসেবে পথচলা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। তার লেখা সুরে দেশের সুনামধন্য গায়ক-গায়িকারা কণ্ঠ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম বাংলা গানের যুবরাজ খ্যাত আসিফ আকবর, ডলি সায়ন্তনী, সেরা কণ্ঠের আশিক কিশোর পলাশ, গামছা পলাশ, সালমা, কাজী শুভ রাজিব শাহ্, শারমিন, প্রথিক উজ্জ্বল, ক্ষুদে গানরাজ আশা, প্রান্ত প্রমুখ। এছাড়াও জনপ্রিয় ব্যান্ড লালন এর মৌলিক গান পাগল চিনে না, রুহানি,পাগলা ঘোড়া গান গুলো পাগল হাসান এর কথা ও সুরে প্রকাশিত হয়। তার লেখা গানের সংখ্যা দুই হাজারের অধিক প্রকাশিত গানের সংখ্যা সত্তরের অধিক। তার নিজের কণ্ঠে প্রকাশিত পনেরটারও বেশি। পাগল হাসানের প্রকাশিত সব গান শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় গান— ‘আসমানে যাইও না’,  ‘১,২,৩ জীবন খাতা’, ‘আন্ধারপুরির মানুষ আমি, ‘মানুষ ম‌ইরা গেলে’, ‘মাটির বালাখানা’, ‘ভুলিয়া না যাইও’, ‘আমার বাড়ি র‌ইলো নিমন্ত্রণ’, ‘পুরুষ নির্যাতন’, ‘সোনা বন্ধুর ভাঙ্গা নায়’, ‘কথা রাখলা না মাদুলি’ ইত্যাদি। তার নিজের গাওয়া ‘আন্তঃনগর’ নামে এলবাম বের হয় ২০১২ সালে।


মোহাম্মদ মতিউর রহমান হাসান থেকে আজকের পাগল হাসান হতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। পাগল হাসান একদিনে হয়ে ওঠেননি। তার বুকে চাপা কষ্ট, ক্ষোভ অবহেলা তার গানের কথায় ফুটে উঠেছে। ২০০৯ সালে এক সময় পারিবারিক, সাংসারিক নানামুখী চাপের কারণে তিনি আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত বারবার নিতে চেয়েছিলেন। আত্মহননের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে না আসলে হ‌য়তো পাগল হাসান হয়ে ওঠা হতো না, অকালেই নিভে যেতো আশার মশাল। কলির যুগে যেখানে একটা গান হিট হলে আকাশে উড়তে থাকে গায়ক-গায়িকারা। সেখানে পাগল হাসান ছিলেন বিপরীত। তার লেখার গতি যত বৃদ্ধি পেয়েছে তত বেশি সমাদৃত হয়েছে। তিনি তত বেশি মাটির মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে, তত বেশি সাধনায় মনোনিবেশ করেছে।


ব্যক্তি জীবনে পাগল হাসান সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। ‘শুকরিয়া গরিব রে দিছো আত্মা বিশাল বড়ো, আমৃত্যু পাগল হাসান রে গরীব রাইখা মারো’। নিজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের নেশা তার কখনোই ছিল না। দেশের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল গভীর। নিজে ভালো থাকার চেয়ে সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা অব্যাহত ছিল আমৃত্যু। কর্ম জীবনে তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ এর অফিস সহায়ক পদে ২০০৪ সালে যোগদান করেন।বাউল সত্ত্বা যার মন মগজ, শিরা উপশিরায় বিদ্যমান তার কি চাকরিতে মন বসে? অবশেষে ২০১২ সালে কুমিল্লা সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে পুরোদমে সাধনায় মন নিবেশ করেন। সিলেট এর সুনাম ধন্য মিউজিশিয়ান দের নিয়ে ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘পাগল এক্সপ্রেস’। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পাগল এক্সপ্রেস নিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছেন পাগল হাসান। সুনামগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে চাকরিরত অবস্থায় ১৪ জুলাই ২০০৬ সালে বিবাহিত জীবনে পদার্পণ করেন। স্ত্রীর নাম লুৎফা বেগম এবং ২০২৩ সালে ১জুলাই দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন যুক্তরাজ্য প্রবাসী মর্জিনা আক্তারের সাথে । প্রথম স্ত্রীর ঘরে জন্ম হয় তার চাঁন সুরজ জিনান জিহানের। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পাগল হাসান একাধারে গায়ক, সুরকার ও গীতিকার হিসেবে বহুল আলোচিত ও প্রিয় নাম। তারই ধারাবাহিকতায় ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩ এ স্রোত আয়োজিত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সম্মাননা গ্রহণ এবং ৯ মার্চ গান নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। বাংলাদেশ শিল্পী সমিতি দুবাইতে স্বাধীনতা জয়ন্তী ও বর্ষপূর্তি উৎসব অনুষ্ঠানে তিনি গান পরিবেশন করেন।


তার গানের কথায় যেমন দুঃখ দূরদর্শার চিত্র ফুটে উঠে তেমনি গভীর প্রেমের কথাও ফুটে উঠেছে। ভালোবাসার মানুষ কে না পাওয়ার আর্তনাদ, বিরহের কথা, তেমনি সৃষ্টি কর্তা কে কাছে পাওয়ার আরাধনা,(রাইত হইলে ডরাই) রাসুলের গুনোগান, (রাসুল আমার গলার মালা রে) তার লেখা সুর ছিল সময় উপযোগী। মায়াভরা মাটির গন্ধ মাখা দরদ ভরা ছিলো তার কন্ঠ।তার গায়কি ও লেখায় আধ্যাত্মিক ছোঁয়া লক্ষ করা যায়। কঠিন ও জটিল বিষয়গুলো সহজ বোধগম্য করে তুলতেন তার সূক্ষ চিন্তায়।


সাদা কালোই প্রথম আলো ক্যাপশনে ১৭ এপ্রিল ২০২৪ রাতে ফেসবুকে প্রোফাইল ফটো সাদা কালো করে মহান সাধক তার ভব বাড়ি ছেড়ে আপন বাড়ি ফেরার ইঙ্গিত দেন। ১৮ এপ্রিল ২০২৪ বৃহস্পতিবার ভোরে ছাতক উপজেলায় সুরমা সেতু এলাকায় সিএনজি ও বাস সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই তার ফুলমালা কাঞ্চার সোনার দেহ ত্যাগ করে। ‘কোন দিন জানি ছাইড়া যাইবা কাঞ্চা সোনার দেহ, পাগল হাসান নামে ধরাই রইবে না আর কেহ’— গগনে উড়তে থাকা গানের পাখিটার কণ্ঠ কলম মুহূর্তেই থেমে যায় চিরতরে। বাংলার লোকসংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া।


মাত্র ৩৮ বছর ১০ মাস ১৬ দিন বয়সে অকালে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায় এই গানের পাখি। মরমী সাধক পাগল হাসানের অকাল মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয় বাংলার লোকজ সংস্কৃতির। এমন আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পূর্ণ পাহাড় সম যাতনা, অর্থ কষ্ট নিয়ে সাধন করে যাওয়া গুণী মানুষ শতবছরে একবার জন্ম নেন।


দেহ ত্যাগ কালে স্ত্রী, দুই ছেলে জিনান ও জিহান, মা, বোনসহ অসংখ্য ভক্ত শ্রোতা অনুরাগী রেখে চিরনিদ্রায় শায়িত হন শিমুলতলা গ্রামে। তার মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেয়ে যায় স্বরচিত ও স্বকণ্ঠের প্রখ্যাত গান- ‘আন্ধারপুরের মানুষ আমি, আন্ধারপুরের বাসিন্দা, ও আল্লাহ...আমি এক পাপিষ্ঠ বান্দা’। 


পাগল হাসান লোকসংস্কৃতির অন্যতম একজন। তিনি গান ও সুরের মাঝে ভক্তদের কাছে আজীবন রয়ে যাবেন। আমরা হারিয়েছি একজন অমূল্য রত্নকে। তবে প্রত্যাশা করছি, তার প্রকাশিত গানগুলো লোকসংস্কৃতিতে সংরক্ষিত করা হোক এবং অপ্রকাশিত গানগুলো গুণী শিল্পীদের কণ্ঠে লালিত হোক। 



লেখক : 

সুমন রানা 

গীতিকার ও সংস্কৃতিকর্মী

মাদারগঞ্জ, জামালপুর।