Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ :
মৌলভীবাজারে দীর্ঘদিন ধরে গৃহের আগুনে ভষ্মিভূত হচ্ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক থাকলেও প্রায় দেড় যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি নেতৃত্বের কোন্দলে ছিল বিপর্যস্থকর অবস্থায়। উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন থেকে শুরু করে ওয়ার্ড কমিটিও কোন্দলে জর্জরিত হয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল। শুধু মূল সংগঠন বিএনপিই নয় দলটির অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনেও পড়েছিল কোন্দলের প্রভাব। কেন্দ্রীয় কর্মসূচিও দলটির বিভিন্ন গ্রুপ আলাদা-আলাদাভাবে পালন করতো। সে অবস্থা থেকে পুরোপুরি ইউটার্ণ মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির। উপজেলা, পৌরসভা কমিটি থেকে শুরু করে সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিট এবং অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনে বইছে ঐক্য আর প্রশান্তির সুবাতাস। চলতি বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দলের ঐক্য ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় বিএনপি মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে জননেতা মো. ফয়জুল করিম ময়ূনকে আহ্বায়ক করে ৩২ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। মো. ফয়জুল করিম ময়ূনের নেতৃত্বে জেলা বিএনপির নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটি সদস্যরা দলীয় আভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে জেলায় বিএনপি, যুবদল, কৃষকদল, শ্রমিকদলসহ অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের বিভিন্ন ইউনিটকে এক পতাকাতলে আনতে শুরু করেছেন।
গত ৫ নভেম্বর রাতে জেলা বিএনপির দুই গ্রুপ এক ছাদের নিচে ঐক্যবদ্ধভাবে বসে বৈঠক করে একসঙ্গে পথচলা ও কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর একে একে রাজনগর, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কমিটির নেতাকর্মীরা গৃহদাহ মিটিয়ে কাধে কাধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে প্রায় দেড় যুগের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে চাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনগুলো। উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। এরইমধ্যে ৫ ডিসেম্বর শ্রীমঙ্গল উপজেলা, ৭ ডিসেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলা এবং সর্বশেষ ১২ ডিসেম্বর কুলাউড়া উপজেলা বিএনপির কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনটি উপজেলার কর্মীসভাতেই কয়েক হাজার নেতাকর্মীর সরব উপস্থিতির কারনে এ কর্মীসভাগুলো জনসভায় রূপ নেয়। কর্মীসভাগুলোতে জেলা ও উপজেলার দ্বিধাবিভক্ত নেতারা এক মঞ্চে উপস্থিত থেকে দলকে সুসংগঠিত করতে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে আগামী দিনের সকল কর্মসূচি পালনে আহ্বান জানিয়েছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে জেলার বাকি চারটি উপজেলার কর্মীসভা সম্পন্ন হবে। এ কর্মীসভাগুলোও স্মরণকালের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ কর্মীসভা করার সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে দলটি। সবমিলিয়ে মৌলভীবাজারে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বর্তমানে উদ্দীপ্ত ও চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে।
জেলা বিএনপি সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মৌলভীবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম নাসের রহমানকে সভাপতি এবং মৌলভীবাজার সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করে ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনের পর কিছুদিন ঐক্যবদ্ধভাবে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হলেও এক সময় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এরপর থেকে দুই গ্রুপ কেন্দ্রীয় কর্মসূচি থেকে শুরু করে সকল সাংগঠনিক কর্মকান্ড আলাদা আলাদাভাবে পালন করতে থাকেন। জেলা থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড প্রায় সর্বত্রই স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। প্রায় সর্বত্র সাংগঠনিক কর্মকান্ড ও জাতীয় দিবসগুলো দুই ব্যানারে অনুষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় প্রায় সাড়ে ৫ বছরের অধিককাল চলার পর অবশেষে গত ৪ নভেম্বর মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির ৩২ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন দলটির কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। কমিটিতে আহ্বায়ক মনোনীত করা হয় মৌলভীবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র ফয়জুল করিম ময়ুনকে। আহ্বায়ক কমিটিতে সদস্য মনোনীত হন এম নাসের রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন মাতুক, মিজানুর রহমান, আব্দুর রহিম রিপন, মোশারফ হোসেন বাদশা, অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা, হাজী মুজিবুর রহমান, আব্দুল ওয়ালি সিদ্দিকী, নাসির উদ্দিন মিঠু, আশিক মোশারফ, আব্দুল মুকিত, ফখরুল ইসলাম, মুহিতুর রহমান হেলাল, আব্দুল হাফিজ, মাহামুদুর রহমান, হেলু মিয়া, মনোয়ার আহমেদ রহমান, বকশী মিছবাউর রহমান, মতিন বক্স, মাহাবুব ইজদানী ইমরান, বকশী জুবায়ের আহমেদ, আবুল কালাম বেলাল, জিতু মিয়া, স্বাগত কিশোর দাস চৌধুরী, গাজী মারুফ আহমেদ, আব্দুল হক, দুরুদ আহম্মদ, আশরাফুজ্জামান খান নাহাজ, সেলিম মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, আনিসুজ্জামান বায়েস এবং মহসিন মিয়া মধু। ৪ নভেম্বর আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর ৫ নভেম্বর রাতে কমিটির আহ্বায়ক ফয়জুল করিমের ময়ূনের বাসভবনে কমিটির প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নতুন আহ্বায়ক কমিটির ওই বৈঠকে কমিটির অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সকল দ্বিধা বিভক্তি ভুলে একসঙ্গে দলের সব কার্যক্রম পরিচালনা ও পথচলার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসে এক ব্যানারে, এক মঞ্চে সকল নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এরপর থেকেই দলটির তৃণমূল পর্যায়ে দেখা দেয় চাঙ্গাভাব। পরবর্তীতে একে একে কৃষকদলসহ দলটির অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনে গড়ে ওঠে ঐক্য এবং একে একে রাজনগর, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বিএনপির নেতৃবৃন্দ সকল বিভেদ ভুলে ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত হয়েছেন।
গত ৫ ডিসেম্বর ঐক্যবদ্ধ বিএনপির প্রথম কর্মীসভা শ্রীমঙ্গলে অনুষ্ঠিত হয়। ওই কর্মীসভায় জেলা বিএনপি ও উপজেলা বিএনপির সকল বিভক্ত নেতাকর্মীরা এক মঞ্চে উপস্থিত থেকে দলকে শক্তিশালী করতে স্থানীয় বা তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। ৭ ডিসেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মীসভাতেও একই দৃশ্যের অবতারণা হয়। সর্বশেষ ১২ ডিসেম্বর কুলাউড়া উপজেলার কর্মীসভাও জনসভায় রূপ লাভ করে। জেলা বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় তিনটি কর্মীসভাই জনসভায় রূপ নেয়।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফয়জুল করিম ময়ূন গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আমাকে আহ্বায়ক মনোনীত করে কমিটি ঘোষণার পরপরই আমার প্রথম চিন্তা ছিল জেলা বিএনপির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমানের নির্দেশে, আমার প্রচেষ্টায় ও জেলা আহ্বায়ক কমিটির সকল সদস্যদের সহযোগিতায় প্রথমেই জেলা বিএনপির বিবদমান দুই পক্ষের বিভক্তির অবসান হয়েছে। দীর্ঘদিন পর আমরা এক জায়গায় বসেছি, একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর উপজেলা ও পৌর বিএনপির বিভক্তি দুর করার কাজ চলমান। ইতোমধ্যে রাজনগর, কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার সদর উপজেলা বিএনপিতে ঐক্য ফিরে এসেছে। ইনশাআল্লাহ এ জেলার কোথাও কোন পর্যায়ে বিএনপিতে আর দ্বিধা বিভক্তি থাকবে না। আমি যে উপজেলায় নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলছি সেখানেই ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। জেলা বিএনপির আহয়ক কমিটির সকল নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় আমরা জেলার প্রতিটি উপজেলায় বিএনপিকে এরইমধ্যে একটি শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছি।’