Advertisement
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:
গৃহশিক্ষক, প্রাইভেট পড়া বা কোচিং করাতো দুরের কথা শিক্ষাজীবনে নতুন সহায়ক বই কিনে পড়ালেখা করতে পারেনি সে। একবেলা খাবার জুটলেও আরেক বেলা খাবার জুটানো ছিল কষ্টকর। অনেক বছর দুর্গাপূজায় নতুন জামা কেনা হয়নি নিন্মবিত্ত পরিবারটির সদস্যদের। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারটির আয়ের একমাত্র উৎস সবজির চারা বিক্রি। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ৩ নম্বর কামালপুর ইউনিয়নের প্রান্তিক কৃষকদের গ্রাম আব্দালপুরের বাসিন্দা ওই পরিবারের মেয়ে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী প্রমিতা দেবের (১৯) দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল পুলিশ বিভাগে কনস্টেবল পদে চাকরি করে পরিবারের দুর্দশা লাঘবের। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লিখিত, শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। পরে মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করেও অজ্ঞাত কারনে বাদ পরেন ওই তরুণী। তারপরও হতোদ্যম হননি তিনি। অদম্য ও কঠোর পরিশ্রমী দরিদ্র পরিবারের সন্তান প্রমিতা দেব আবারও পুলিশের কনস্টেবল পদের চাকরি প্রস্তুতি নেন। চলতি বছরে মৌলভীবাজার জেলা থেকে প্রমিতা দেবসহ অনলাইনে ১ হাজার ৫০২ জন আবেদন করেন। গত ৪ নভেম্বর নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে শারীরিক মাপ ও কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য উপস্থিত হন ১ হাজার ২১৯ জন প্রার্থী। সেখান থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ের দ্বিতীয় ধাপে শারীরিক সক্ষমতা পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয় ৮২০ জনকে। এরপর ৫ নভেম্বর প্যাজিক্যাল ইনডোর্স টেস্ট শেষে ৬৮২ জন এবং তৃতীয় ধাপে গত ৬ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষার জন্য ৪৭৫ জন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়। ২৭ নভেম্বর ৪৭৫ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন ৯১ জন। ওই ৯১ জন ৪ ডিসেম্বর মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ওইদিন রাতে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি জেলা পুলিশ সুপার এম. কে. এইচ. জাহাঙ্গীর হোসেন কনস্টেবল পদের চাকরির জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ৫৬ জনের নাম ঘোষণা করেন। এরমধ্যে মেধা তালিকায় ২১ নম্বরে স্থান লাভ করেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান প্রমিতা দেব।
দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ বিভাগে চাকরির যে স্বপ্ন হৃদয়ে ধারণ করছিলেন সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করায় অর্থাৎ পুলিশ বিভাগের কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হবার খবর শুনে আনন্দশ্রæ গড়িয়ে পড়ে প্রমিতা দেবের চোখজোড়া থেকে। প্রমিতা দেব এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন পুলিশের ইউনিফর্মে দেশসেবার জন্য।
এদিকে প্রমিতার পুলিশ বিভাগে কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য নির্বাচিত হওয়ায় শুধু তার পরিবার নয়, পুরো আব্দালপুর গ্রামে বইছে আনন্দের বন্যা। প্রমিতাকে শুভেচ্ছা জানাতে তার ছোট কুটিরে লেগেই আছে গ্রামবাসীদের ভিড়।
প্রমিতা দেবের পরিবারিক সূত্র জানায়, বাবা লাল্টু দেব ও চার বোন নিয়ে তাদের সংসার। মা দিপালী রানী দেব অসুস্থ্য থাকায় ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের রান্না-বান্নাসহ সব কাজ নিজের হাতে তুলে নেয় প্রমিতা। অর্থনৈতিক টানাপোড়নে অনেক দিন ওই পরিবারের উপবাসে দিন কেটেছে। তিন বেলার খাবার কোন কোন দিন এক বেলা জুটেছে। অনেক দিন পরিবারটির সদস্যরা শুধুমাত্র লবন-ভাত খেয়ে দিন কাটিয়েছে। তবুও লেখাপড়া ছাড়েনি অদম্য প্রমিতা। ২০১৪ সালে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যান প্রমিতার মা দিপালী রানী দেব। ২০১৫ সালে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বিয়ে হয় পরিবারের প্রমিতার বড় বোনের। পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস হলো পরিবারের কর্তা লাল্টু দেবের সবজির চারা বিক্রি। তিনিও অনেকদনি যাবত অসুস্থ্য থাকায় এ আয়ের উৎসও অনেকটাই বন্ধ হবার পথে। বিকল্প না থাকায় যখন পরিবারের সদস্যরা চোখে অন্ধকার দেখছিলেন তখনই অন্ধকারে আলো হয়ে দেখা দিয়েছে প্রমিতার পুলিশ কনস্টেবল পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়া।
সরেজমিনে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ৩ নম্বর কামালপুর ইউনিয়নের আব্দালপুর গ্রামে গিয়ে জানা যায় এ গ্রামে প্রায় সাড়ে তিনশত সনাতন পরিবারের বসবাস। এসব পরিবারের অধিকাংশই হলো নিন্মবিত্ত প্রান্তিক কৃষক।
প্রমিতা দেবের কাকি (চাচি) রিতা দেব বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর আগে প্রমিতার মা মারা যান। তখন প্রমিতা একেবারে ছোট। পরের বছর তার বড়বোনের বিয়ে হয়ে যায়। ওই সময় থেকেই প্রমিতা পরিবারের রান্নাসহ সকল কারেজ ভাড় নিজের কাধে তুলে নেয়। পাশাপাশি অত্যন্ত পরিশ্রম করে নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে যায়। প্রমিতা পুলিশের চাকরির পরীক্ষা দিতে যাবার আগের দিন তার কাকা (চাচা) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ অবস্থায় পরদিন চোখের জল (পানি) ফেলকে ফেলতে সে পরীক্ষা দিতে যায়। এখন চাকরি পেয়েছে শুনে আমাদের পুরো পরিবার আননন্দিত।’
প্রমিতার প্রতিবেশী ভানু লাল দেব বলেন, ‘প্রমিতা পরিবারের দায়িত্ব পালনের সাথে লেখাপড়া চালাতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। জীবনে কোন দিন প্রাইভেট পড়তে পারেনি মেয়েটি। অনেক কষ্ট করে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। এখন সে পুলিশে চাকরি পাওয়ায় আমরা গ্রামবাসীরা খুবই খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি লাগছে বিনা ঘুষে, বিনা তদবিরে, কোন টাকা খরচ না করে চাকরি পাওয়ায়। সেজন্য আমরা নিয়োগ কমিটির সকলকে ধন্যবাদ জানাই।’
প্রমিতার প্রতিবেশী ইলা দেব বলেন, ‘ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে মেয়েটি অকুল সাগরে নিপতিত হয়। অনেক দিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে প্রমিতা আমাদের বাড়িতে এসে খাবার খেত। আমি আগে জানতাম টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি হয় না। গত বছর পুলিশে নিয়োগের সময়ও ভালো করলেও টাকা না থাকায় তার চাকরি হয়নি। এবার চাকরির পরীক্ষার সময়ও অনেকে বলেছেন টাকা ছাড়া চাকরি হবে না। কিন্তু এবার দেখলাম বিষয় ভিন্ন। কোন টাকা ছাড়াই দরিদ্র পরিবারের সন্তান প্রমিতার চাকরি হলো। এ চাকরির কারনে একটি পরিবার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেল।’
প্রমিতা দেবের বাবা লাল্টু দেব বলেন, ‘অনেক কষ্টে খেয়ে না খেয়ে চলে আমাদের পরিবার। অনেক দিন শুধু পানিই আমাদের একমাত্র খাবার হয়। আমার মেয়ে মানুষের সাহায্যে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। বাড়ির সকল কাজের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে গেছে সে। তার চাকরিটা হওয়ায় অনেক খুশি হইছি।’
আলাপকালে প্রমিতা দেব বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল পুলিশ বিভাগে চাকরি করে পরিবারের হাল ধরা ও দেশ সেবা করার। আমার মাও চাইতেন আমি যেন পুলিশে চাকরি করি। আমার চাকরি পুলিশে হলো কিন্তু মা দেখে যেতে পারিননি। আমার বয়সী মেয়েরা যেখানে সকাল ৮টা বা ৯টা আগে ঘুম থেকে ওঠেনা সেখানে আমাকে বছরের ৩৬৫ দিনই ভোর ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠে ঘরে কিছু থাকলে তা দিয়ে পরিবারের রান্না বান্না করে স্কুলে যেতে হতো। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজ এই শিক্ষাজীবনে কোনদিন কোচিং কিংবা প্রাইভেট পড়তে পারিনি। যা পড়ার সবই স্কুল বা কলেজের শ্রেণিকক্ষেই পড়তাম। নতুন সহায়ক বই কেনা ছিল আমার পরিবারের কাছে পাহাড়সম বিলাসিতা। শুধুমাত্র পরীক্ষার সময় সকালে বাড়িতে রান্না বান্নার কাজ শেষ করে সহপাঠীদের সহায়ক বই থেকে নোট করে বা মূল বই থেকে পড়া শেষ করে পরীক্ষার হলে যেতাম। আমার স্কুল কলেজের শিক্ষকরা আমাকে শিক্ষাজীবনে প্রচুর সাহায্য করেছেন। আর প্রায় প্রতি বছরই ভর্তির সময় টাকা দিয়ে সহায়তা করেছেন আমাদের গ্রামের প্রতিবেশিরা। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। আগে শুনতাম টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি হয় না। কিন্তু আমি অনলাইনে আবেদন ফি এবং গ্রাম থেকে শহের যাতায়াত খরচ ছাড়া আর কোন টাকা কোথাও ব্যয় করিনি। যাতায়াত খরচের টাকাও প্রতিবেশিদের দান।’
এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার এম. কে. এইচ. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে এবারের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আশা করবো যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা সাধারণ মানুষকে সে রকম সততা, নিরপেক্ষতা এবং দুর্নীতিমুক্ত হয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গে সেবা দেবেন।’
উল্লেখ্য, এবারের পুলিশ বিভাগের কনস্টেবল পদে মৌলভীবাজার জেলায় যে ৫৬ জন প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছে এরমধ্যে সাধারণ কোটায় রয়েছেন ৫৫ জন ও উপজাতি কোটায় রয়েছে ১ জন। সাধারণ কোটায় নির্বাচিত ৫৫ জনের মধ্যে রয়েছে ২ জন দরিদ্র চা শ্রমিক সন্তান। তারা হলো জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের আলীনগর চা বাগানের শ্রমিক দিলীপ রবিদাসের ছেলে সুজিৎ রবিদাস এবং একই ইউনিয়নের সুনছড়া চা বাগানের হরি নারায়ন বিনের ছেলে সুজিত কুমার বিন।