Advertisement
মোঃ মজিবর রহমান শেখ, ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি:
অভাবের তাড়নায় অসুস্থ বাবাকে নিয়ে পথে পথে ঘুরছে ২ শিশু তাদের বয়স ৬ আর ৮ । এই বয়সেই তাদের কাঁধে বাবার দায়িত্ব। যে বয়সে খেলাধুলা ও স্কুলের বারান্দায় থাকার কথা সেই বয়সে অসুস্থ বাবার ২ কাঁধের শক্তি হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে তারা। খাবারের সন্ধানে ২ চাকার ঠেলাগাড়ি নিয়ে প্রতিনিয়তই গ্রাম ও শহরের অলিগলি ঘুরছে। বাবাকে সুস্থ করার জন্য এর-ওর কাছে সাহায্য তুলছে এই ২ শিশু।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ পৌর এলাকার জগথা গ্রামের বাসিন্দা আইনুল হকের ছেলে (৩৩) জসীম উদ্দিন। ৫ বছর আগে কুলির কাজ করতে গিয়ে শরীরের ওপর আলুর বস্তা পড়ে যায়। এতে মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা নিলেও অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসাও করাতে পারেননি। এরপর থেকে ২ চাকার একটি ঠেলাগাড়িতে শুয়ে-বসেই দিন কাটে জসীমের। তার এই দুঃসময়ে আত্মীয়স্বজনেরা পাশে না থাকায় শক্ত হাতে বাবার হাত ধরে শিশুসন্তান মিম ও আলিফ। মূলত তাদের ওপর ভর করেই জসীম উদ্দিন চলাফেরা করেন। জসীম উদ্দিনের ৮ বছর বয়সী মেয়ে মিম আক্তার ও ৬ বছর বয়সী ছেলে আলিফ স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করলেও অভাব-অনটনের জন্য নিয়মিত সহপাঠীদের সঙ্গে পাঠদানে অংশ নিতে পারে না। কেননা একদিন বাবাকে নিয়ে বের না হলে যে অনাহারে থাকতে হয় তাদের। জসীম উদ্দিনের নিজের বলতে কিছুই নেই। বর্তমানে যেখানে রাত্রিযাপন করছেন সেটিও অন্যের। জসীম উদ্দিন অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই তার বৃদ্ধ বাবা আইনুল হক কুলির কাজ করে যা উপার্জন করে তা দিয়ে কোনোমতে জীবন নির্বাহ করছেন তারা। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে (বড় মাঠ) ২ শিশুকে দেখা যায় একটি ঠেলাগাড়ি নিয়ে মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। ঠেলাগাড়িতে কাঁথা-কম্বল নিয়ে শুয়ে আছেন তাদের বাবা জসীম উদ্দিন। আর পাশে বসে আছেন তার স্ত্রী রফিকা বেগম। কাছে গিয়ে তাদের পরিচয় জানতে চাইলে এই ২ শিশু জানায় তাদের নাম মিম ও আলিফ। তারা ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ থেকে এসেছে। বাবার ভালো চিকিৎসার জন্য শহরের মানুষের কাছে সাহায্য চাচ্ছে, যাতে তাদের বাবাকে ভালো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাতে পারে এবং আগের মতো যেন হাঁটাচলা করতে পারে।
স্কুলে যাওয়া হয় কি না এমন প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ থাকে তারা। আবারও জিজ্ঞাসা করলে ছলছল চোখে জানায় স্কুল গেলেও খুব কম। বাবার সঙ্গেই সারাদিন থাকতে হয়। তারা ছাড়া বাবা অচল। এ সময় পাশে থাকা জসীম উদ্দিনের স্ত্রী রফিকা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, স্বামী ও ২ সন্তান নিয়ে খুব খারাপ অবস্থায় দিনাতিপাত করছি। ৫ বছর থেকে আমার স্বামী অসুস্থ। হাঁটাচলা করতে পারে না। আয়ের রাস্তা একেবারেই বন্ধ। আমার বৃদ্ধ শ্বশুর কুলির কাজ করে সারাদিনে যা আয় করে তা দিয়ে তারা চলেন এবং আমাদেরও কিছু দেন। একবেলা খেলে আরেক বেলার চিন্তা করতে হয়। এরপর স্বামীর জন্য ঔষুধ তো আছেই। নিজের জায়গাজমি বলতে কিছুই নেই। অন্যের বাড়িতে বসবাস করি। সবদিক থেকেই অন্ধকার।
তিনি আরও বলেন, বাচ্চা ২টাকে স্কুলে ভর্তি করেছিলাম কিন্তু লেখাপড়ার খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে স্বামী ও ২ শিশুসন্তানকে নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। সরকার থেকে তেমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও মেলে না, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
অসুস্থ জসীম উদ্দিন বলেন, ৫ বছর আগে কুলির কাজ করতে গিয়ে আমার শরীরে আলুর বস্তা পড়ে যায়। এতে আমার কোমরের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে চিকিৎসা করেছি। তারপরও সুস্থ হয়ে ওঠতে পারিনি। ডাক্তার বলেছেন উন্নত চিকিৎসা করাতে হলে অনেক টাকা লাগবে। কিন্তু আমার পক্ষে এত টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তাই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারিনি। প্রতিনিয়তই ব্যথা-যন্ত্রণা করে কিন্তু অভাবের তাড়নায় সব সহ্য করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, বাড়ির পাশেই অস্থায়ীভাবে একটি চা-পানের দোকান দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী সারাদিন চালাতো। কিন্তু সেটাও অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম কিন্তু তাদের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারি না। আমার স্ত্রী একহাতে আর কত করবে। এদিকে সাহায্য ছাড়া আমি হাঁটাচলা করতে পারি না। আমার ভরসা আমার পরিবার। ছেলে-মেয়ের সাহায্যেই আমি চলাফেরা করি। তারা আমার ঠেলাগাড়ি টেনে নিয়ে যায় শহরের বিভিন্ন স্থানে। মানুষজন যা সাহায্য করে তা দিয়ে আমার পরিবার চলে। চিকিৎসার জন্য সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চান তিনি, স্বপ্ন দেখেন সন্তানরা আবারও বিদ্যালয়ে যাবে।