lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
Last Updated 2025-02-05T07:32:08Z
জাতীয়

শ্রীমঙ্গলে নাশকতা মামলায় আসামি হয়ে পলাতক চার ইউপি চেয়ারম্যান, নাগরিক সেবা ব্যাহত

Advertisement


 

ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেই মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অনেকটাই ভেঙে পড়েছে স্থানীয় সরকারের চারটি ইউনিয়ন পরিষদের সার্বিক কার্যক্রম। উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের মধ্যে ওই চারটি ইউনিয়নে সৃষ্টি হয়েছে অনেকটা অচলাবস্থা। নাশকতা মামলার আসামি হিসেবে ওই চার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন আত্মগোপনে। আত্মগোপনে থাকা চার চেয়ারম্যান হলেন উপজেলার ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বিজয় বুনার্জী, ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক প্রানেশ গোয়ালা, ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আব্দুর রশিদ এবং ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রনেন্দ্র প্রসাদ বর্ধন জহর। অন্যদিকে এলাকায় থেকে নিজ দায়িত্ব পালন করছেন ১ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিছলু আহমদ চৌধুরী, ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দুধু মিয়া, ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন আরাফাত রবিন, ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মতলিব এবং ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দেবাশীষ দেব রাখু। 

জানা যায়, ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নয়টি ইউনিয়নের মধ্যে ছয়টিতে নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। বাকি তিনটি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা হলেন ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আব্দুর রশিদ, ৫ নম্বর কালাপুর ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মো. আব্দুল মতলিব,৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রনেন্দ্র প্রসাদ বর্ধন জহর, ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বিজয় বুনার্জী, ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক প্রানেশ গোয়ালা এবং ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়নে ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা দেবাশীষ দেব রাখু। এরমধ্যে ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রশিদ, ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রনেন্দ্র প্রসাদ বর্ধন জহর, ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জী এবং ৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রানেশ গোয়ালার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নাশকতা মামলা হওয়ায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সাধারণ জনগণের কাছে তাদের কোনো খোঁজখবর নেই। চার চেয়ারম্যান আত্মগোপনে থাকায় সঠিক সময়ে কাঙ্খিত নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তৃণমূলের মানুষ। যথাসময়ে পাচ্ছেন না জন্ম নিবন্ধন সনদ, মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিকত্ব সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, উত্তরাধিকার সনদ, মাসিক/বাৎসরিক আয়ের সনদ, অবিবাহিত সনদ, চারিত্রিক সনদ পুনঃবিবাহ না হওয়ার সনদসহ অন্যান্য সনদ ও প্রত্যয়নপত্র। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সেবাগ্রহীতারা। ফলে প্রতিদিন ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। আত্মগোপনে থেকেও কোন কোন চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে গোপন স্থান থেকে সাধারণ মানুষের নানা সনদ ও প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর করছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলোর সচিবরা।

মঙ্গলবার (৪ ফেব্রæয়ারি) ওই চারটি ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে সরজমিনে গিয়ে চেয়ারম্যানদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও চার চেয়ারম্যানের মধ্যে তিন চেয়ারম্যানের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

উপজেলার ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়নের পাত্রিকুল গ্রামের আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘আমি আমার ছোট ভাইয়ের ছেলের জন্ম নিবন্ধন করতে তিন দিন ইউনিয়ন পরিষদে এসেছি। এখনো জন্ম নিবন্ধন সনদ হাতে পাইনি। সচিব সাহেব বলেছেন ২-১ দিনের মধ্যে সনদটি আমাকে দেবেন।’ একই ইউনিয়নের লইয়ারকুল গ্রামের এক প্রবাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি নাগরিক সনদের জন্য একাধিক দিন এসেছি। আজও চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য সনদটি পাইনি। কবে পাবো জানি না।’ 

ওই ইউনিয়নের সচিব রবীন্দ্র চন্দ্র দেব বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব মাঝে-মধ্যে আইন (আসেন) আরকি। তাইন (তিনি) অসুস্থ্য। বাড়ি থাইক্কা (থেকে) অফিস করইন (করেন)। মাঝে-মধ্যে বিকালে আইয়া অফিস টাইমে শেষদিকে কাগজপত্রে স্বাক্ষর দেইন (দেন)। ওভাবে তাইন (তিনি) চালাইয়া যাইরা।’

৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ডেংগারবন (জানাউড়া) গ্রামের মো. রজব আলী বলেন, ‘আমার মেয়ে শফিকুন্নেছার জন্ম নিবন্ধন করতে দিয়ে গেছিলাম কয়েকদিন আগে। এর মধ্যে কয়েক দিন ইউনিয়নে এসেও চেয়ারম্যানকে পাইনি। তবে সচিবের মাধ্যমে আজ আমার মেয়ের জন্ম নিবন্ধন হাতে পেলাম। শুনেছি চেয়ারম্যান সাহেব পরিষদে আসেন না। তিনি কোন স্থান থেকে স্বাক্ষর দিয়েছেন তা আমি জানি না।’

ওই ইউনিয়ন পরিষদের সচিব দীপক কুমার শর্মাকে ইউনিয়ন কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মুঠোফোন নম্বরে কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে এই ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের চেয়ারম্যান স্যার ইউনিয়ন পরিষদে না আসলেও জনগণের কোন কাজ-কর্ম বন্ধ নেই। কেউ কোন কাগজপত্র নিয়ে আসলে চেয়ারম্যান স্যারের স্বাক্ষর এনে তাদের হাতে কাগজ পৌছে দেই। এতে কেউ বিড়ম্বনার শিকার হন না।’

৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের রাজঘাট চা বাগানের নারী শ্রমিক গীতা বুনার্জী বলেন, ‘আমি একটা কাজে বেশ কয়েকদিন ধরে ইউনিয়ন পরিষদে বারান্দায় ঘুরতেছি। চেয়ারম্যান বাবুরে পাই না। তাইন কই আছইন কেউ কয়ও না।’

ওই ইউনিয়ন পরিষদের সচিব নারায়ন চন্দ্র গোস্বামী বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব আতকা আতকা (মাঝে-মধ্যে) পরিষদে আসেন। আবার বাইরে বিচার-আচারে বাইরে গেলে তানরে পাওয়া যায় না। তবে কারো কোন দরকার হলে তাইনের মোবাইলে ফোন করলেও তানরে পাওয়া যায়।’

৮ নম্বর কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের বিলাসছড়ার বাসিন্দা জয়তুন বলেন, ‘আমি গত সপ্তাহে একটি বিশেষ কাজে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে এসেছিলাম। সেদিন পাইনি। আজও এসেছি, তিনি নেই। পরিষদের কেউ বলেও না তিনি কোনদিন আইবা।’

ওই ইউনিয়ন পরিষদের সচিব সঞ্জয় নায়েক বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব অফিসিয়্যালি সব কাম-কাজ করেন। তবে তিনি রেগুলার পরিষদে আসেন না। মানুষের নানাবিদ সনদের আবেদন আমরা সংগ্রহ করে রাখি। যেদিন চেয়ারম্যান সাহেব আসেন সেদিন আমরা স্বাক্ষর নিয়ে মানুষকে দেই। তিনি নিয়মিত না আসলেও মানুষের কোন সমস্যা হয় না।’

কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রানেশ গোয়ালা মুঠোফোনে বলেন, ‘দরকার হলে ফোন দিলে পাইবেন। সব সময় পরিষদে যেতে পারি না। এখনো বাইরে আছি।’ বলেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। তিনি ছাড়া ২ নম্বর ভুনবীর ইউনিয়ন পরিষদের

চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রশিদ, ৬ নম্বর আশীদ্রোন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রনেন্দ্র প্রসাদ বর্ধন (জহর) ও ৭ নম্বর রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জীর মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, ‘আমি এ উপজেলায় যোগদান করেছি খুব বেশিদিন হয়নি। পরিষদের চেয়ারম্যানদের

অনুপস্থিতির বিষয়টি আমার জানা নেই। এর আগে কেউ আমাকে লিখিত বা মৌখিকভাবে জানাননি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’