lisensi

Advertisement

Picsart-23-09-20-19-46-51-668
বাংলাদেশ প্রকাশ
মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫
Last Updated 2025-04-15T09:59:07Z
শিল্প ও সাংস্কৃতি

বিলুপ্তপ্রায় ‘গাজির গান’-এ মুগ্ধ শ্রীমঙ্গলবাসী

Advertisement


 

ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার:

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩ নম্বর শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের পর্যটন গ্রাম রাধানগরের সড়ক ধরে একটু সামনে এগোতেই ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যালয়। এ কার্যালয়ের পাশের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দিয়ে পাহাড়ি ছড়ার পাশে বিশাল একটি মাঠ। এ মাঠেই বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে বসেছিল বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য বিলুপ্তপ্রায় ‘গাজির গানের’ আসর। ঝিরিঝিরি বাতাসে গ্রামীণ মনোমুুগ্ধকর পরিবেশে খোলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত এ গান বা গীতকে উপভোগ করতে জমায়েত হয়েছিলেন শ্রীমঙ্গলে ভ্রমণে আসা পর্যটকসহ হাজারো নারী-পুরুষ। সোমবার (১৪ এপ্রিল) রাতে দেশের একমাত্র পর্যটন ও জাগ্রত গ্রাম হিসেবে পরিচিত রাধানগর গ্রামবাসীর আয়োজনে ও পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সহযোগিতায় মঞ্চস্থ হয় সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুরের প্রাচীন কালের জনপ্রিয় লোকসংস্কৃতি গাজীর গান বা গাজী পীরের বন্দনা গীতি। 

গায়ে বিচিত্র রঙের আলখাল্লা, গলায় মালা, দুই হাতে দুটি লাল কাপড়ের রুমাল সদৃশ্য টুকরো, পায়ে ঘুংঘুর, মাথায় গোলাকার মুকুট পরে আসরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে গান পরিবেশন করেন গায়েন মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ পৌর এলাকার নসরতপুরের বাসিন্দা মো. আব্দুস শহীদ। তার সাথে ছিলেন ঢুলি মাস্টার, করতাল মাস্টার, জুড়ি মাস্টারসহ ছয় জনের একটি দল।

‘প্রথমে বন্দনা করি আল্লারই চরন, তারপরে বন্দনা করি নবীজির চরন। এরপর বন্দনা করি গাজী জিন্দা পীর, আইসো আইসো দেওয়ান গাজী বসতে দিলাম পিড়ে, অধম বালকে আমরা ডাকি নত শিরে। আল্লার নাম লইলাম না রে দিলের ঘুমানে, আল্লা বিনে বান্দব নাই এই ভব সংসারে’। সঙ্গে ঢোলক, করতালবাদক ছাড়াও চারজন জুরি বা দোহারের সম্মিলিত গান, তাল আর সুরের অপূর্ব মূর্ছনা। এলাকাবাসী, শ্রীমঙ্গলে ভ্রমণে আসা পর্যটক, নারী-পুরুষসহ উপস্থিত হাজারো দর্শক-স্্েরাতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেন আবহমান বাংলার বিলুপ্তপ্রায় গাজির গানের পালা।

পর্যটন নগরী শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে আসা পর্যটক ঢাকার ব্যবসায়ী শামীম হোসেন গাজীর গান উপভোগ করে বলেন, ‘আমাদের ছোটবেলায় নানাবাড়ি নোয়াখালিতে গাজীর গানের আসর দেখতাম। আবহমান বাংলার শেকড়ের সংস্কৃতি হলো এ গাজীর গান। কিন্তু কালের বিবর্তনে, আধুনিকতার যাতাকলে ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় গাজীর গান বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।’

শ্রীমঙ্গলের কলেজ শিক্ষার্থী আকাশ দেব বলেন, ‘গাজীর গানের কথা দাদুর কাছে শুনেছি। আগে নাকি এ গানটি গ্রামের মানুষের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম ছিল। এ গানের মনের আবেগ-অনুভূতি, সুখ-দুঃখ, জীবনের অংশ নিয়ে সংগীত পরিবেশন করা হতো। এখনো দেশের বিভিন্ন জেলায় নাকি গাজীর গান হয়। আমার এ গানটি দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। রাধানগর গ্রামবাসীর আয়োজনে গাজীর গান দেখার সুযোগ হলো। অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ আয়োজকদের।’

মৌলভীবাজারের গণমাধ্যমকর্মী এম. এ হামিদ বলেন, ‘প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় হােিরয় যাচ্ছে আমাদের গ্রাম-বাংলার ঐহিত্য আর উৎসব। হারিয়ে যাচ্ছে লোকসংগীত জারি-সারি গান। রাধানগর গ্রামবাসী বর্ষবরণে হারিয়ে যেতে বসা আমাদের ঐতিহ্য গাজীর গানের যে আয়োজন করেছে তা আমার কাছে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর মনে হয়েছে। আমি পেশাগত দায়িত্ব পালনে এখানে এসে মুগ্ধ ও বিমোহীত।’ 

রাধানগর পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সদস্য তাপস দাশ বলেন, ‘রাধানগর গ্রামবাসীর আয়োজনে এবং পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সহযোগিতায় এবারই প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়েছে। রবিবার (১৩ এপ্রিল) রাত ১১টা থেকে সারারাত জেগে গ্রামবাসী ও পর্যটকদের অংশগ্রহণে রাধানগর সেতু আল্পনায় সাজিয়ে রঙতরঙ্গ সেতু নামকরণ করে তার সোমবার (১৪ এপ্রিল) দুপুরে তা উদ্বোধন করা হয়। পরে গ্রামের মানুষ, হোটেল-রিসোর্ট কর্মী ও পর্যটকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। এছাড়া দিনব্যাপী ট্যুরিস্ট পুলিশ অফিস সংলগ্ন মাঠে স্বল্প পরিসরে বৈশাখী গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেলায় স্থানীয় পণ্যের স্টল, হস্তশিল্প প্রদর্শনী ও পান্তা-ইলিশ আয়োজন করা হয়। বিকেলে হোটেল-রিসোর্ট স্টাফ, পর্যটক, স্কল শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় দৌড়, দড়ি (রশি) টানাটানি, বালিশ খেলা ইত্যাদি। রাতে আমরা আয়োজন করেছি গাজির গান। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী গাজির গান আমাদের সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। নব প্রজন্মের কাছে এ গানটির ঐতিহ্য তুলে ধরতেই আমরা এটির আয়োজন করেছি। হাজারো মানুষ গাজীর গান উপভোগ করেছেন। আগামীতে আরো সমৃদ্ধ পরিসরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করার প্রত্যাশা আমাদের।’